প্রশ্ন : সম্প্রতি ৭ বছরের শিশু জারিফের (ছদ্মনাম) সামনে তার মা বখাটে কর্তৃক ধর্ষণ শিকার হয়। জারিফের গলায় ছুরি ধরে বখাটেরা তার মাকে জিম্মি করে। এসময় জারিফ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই ঘটনার পর থেকে জারিফ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বারবার ভয়ে মূর্ছা যাচ্ছে। প্রচুর কান্নাকাটি করছে। ভুক্তভুগী ওই নারীও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। লজ্জায় ছেলের সামনে দাঁড়াতে পারছেন না। কথা বলছেন না। নিজেকে গুটিয়ে রাখছেন। এ অবস্থায় মা ও সন্তানের জন্য করণীয় কী? ধর্ষকদের মানসিক অবস্থার পরিস্থিতি কী? কেন তারা এমন বীভৎস কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে মনে করেন? সামাজিকভাবে এর প্রতিকারে কী করণীয়?
-নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর : এখানে সত্যি কথা বলতে কি মা ধর্ষণে শিকার হয়েছে এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো ঘটনাটি ঘটেছে ছোট্ট বাচ্চার সামনে। এখন ভিকটিম কিন্তু দুজনই। মা যেমন ভিকটিম ওই ছেলেটাও ভিকটিম। ছেলেটি ভিকটিম কিসের? ছেলেটা একটা সন্ত্রাসী কাজ প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা স্বয়ং নিজের মায়ের বিপরীতে।
মাকে সে স্বাভাবিকভাবেই অধিক ভালোবাসে। মা সবথেকে আপনজন। একটা সাত বছরের বাচ্চা ধর্ষণে আসল বিষয়টা নাও জানতে পারে কিন্তু যে যেভাবে তার ওপর আক্রমণ করা হয়েছে একাধিক লোক মিলে তার মাকে নির্যাতন করেছে তাতে তার আতঙ্কিত হওয়াটা স্বাভাবিক। যদি ধর্ষণ না করা হতো, যদি তার মাকে ফিজিক্যালি আক্রমণ করত তাহলেও সেটাও আতঙ্কিত হওয়ার কারণ হয়ে যেত। এরকম একটা ভয়ংকর লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে যেটা বাচ্চাটার সবথেকে আপন জনের বিরুদ্ধে। যার সবটুকু ভয় হিসেবে তার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।
এই আতঙ্কটা দূর করা খুবই কঠিন কাজ। তার মনের মধ্যে এটা অনেক সময় ধারণ করবে। মাঝে মাঝে সে আতঙ্কিত হবে, এ জাতীয় ঘটনা বা এ জাতীয় বিষয় শুনলেও সে আতঙ্কিত হবে, এমনকি এ জাতীয় ছবি দেখলেও সে আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। মা সম্পর্কে হয়ত তার ধারণা খারাপ হবে না কিন্তু সে যখন বুঝবে তার মাকে সে সাহায্য করতে পারেনি তখন তার ভিতরে একটা অপরাধবোধও কাজ করতে পারে। হয়ত সেটা নাও হতে পারে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটার ছাপ থেকে যাবে।
এখন দুটোই কিন্তু ক্রাইসিস। আমরা বলি ইন্টারভেনশন। যখন মানুষ খুবই বিপদে থাকে বা বড়ো একটা অসুস্থতার মধ্যে থাকে তখন সেটা ভীষণ রকম ক্রাইসিস হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে মায়ের যেমন ক্রাইসিস ইন্টারভেনশন দরকার, ছেলেটারও তেমন দরকার। সুতরাং এখানে কিন্তু মা নিজে একজন আতঙ্কগ্রস্ত এবং ছেলেটাও।
মা এবং ছেলেটার খুব আপনজন যারা আছে, ভাই-বোন আছে, আত্মীয়-স্বজন যারাই আছে তাদের খুব ঘনিষ্ঠ আচরণ দরকার বাচ্চাটাকে স্বাভাবিক করতে। বাচ্চাটাকে কোনোভাবেই একা থাকতে দেয়া যাবে না, যত দ্রুত সম্ভব তার মায়ের সাথে সম্পর্কটাকে আবার স্বাভাবিক করতে হবে।
সবাই মিলে একসাথে মাকেও যেমন সাপোর্ট করতে হবে, বাচ্চাটাকেও সাপোর্ট করতে হবে। এরপরেও যদি ঠিক না হয় তাহলে চিকিৎসকের শরানাপন্ন হতে হবে। অনেক সময় এরকম আঘাতে শুধুই কাউন্সেলিং করে সমাধান হয় না। সে ক্ষেত্রে সাপোর্টিভ মেডিটেশনের দরকার হতে পারে।
এ অবস্থায় মায়ের তীব্র ঘুমের সমস্যা হতে পারে, ভয়ের কারণে তার তলপেটে ব্যথা হতে পারে, অ্যাকিউট প্যানিট অ্যাটাক হতে পারে, অ্যাংজাইটিও হতে পারে। সেজন্যই প্রয়োজন মতো তাকে ওষুধ দেয়া লাগতে পারে। বাচ্চাটাকেও দেয়া লাগতে পারে। প্রথম কথা হলো তাদেরকে সামাজিক সাপোর্ট দেওয়া, সাইকোথেরাপি কাউন্সেলিং করা, পরিবারের সদস্যদের ঘনিষ্ঠ হওয়া; এরপরও যদি সমস্যা তীব্র হয়, যেমন ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে যাওয়া, ভয়ে আতঙ্কিত হওয়া, একেবারেই ঘুমাতে না পারা।
যদি এরকম হয় তাহলে দুজনের ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এজন্য প্রাথমিক কাজগুলো করার পাশাপাশি উভয়কেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা দ্রæত স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে পারবে।
পরামর্শ দিয়েছেন,
অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী
সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস
এই বিভাগের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন :
সূত্র : ‘মাসিক মনের খবর’ সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যা
- মনেরখবর.কম এর প্রশ্ন-উত্তর বিভাগে, মানসিক স্বাস্থ্য, যৌন স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি সহ মন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আপনার কোনো জানার থাকলে বা প্রশ্ন থাকলে বা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দরকার হলে monerkhaboronline@gmail.com এ মেইল করতে পারেন অথবা মেসেজ করতে পারেন মনের খবর ফেসবুক পেজের ইনবক্সে এবং 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।
এছাড়া মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর/