বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত এক ভারতীয়ের লড়াই

0
131

মনের খবর ডেস্ক : অদ্ভুত এক মানসিক রোগের বাইপোলার ডিজঅর্ডার। এ রোগে আক্রান্ত রোগী কখনো দারুণ উৎফুল্ল থাকেন আবার কখনো ডুবে যান মারাত্মক বিষণ্নতায়। নিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মাত্রাতিরিক্ত আবার কখনো হয়ে যান একেবারেই অলস।

আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, এটি কোনো রোগ নয়। সাধারণভাবে অনেকে ‘ভাব আছে’ বলে এ ধরনের রোগীর সমালোচনা করতে পারে। মনোবিদেরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে একজন মানুষের আবেগের বা মানসিকতার বিপরীতমুখী এ অবস্থা চলতে থাকলে সেটিকে বাইপোলার ডিজঅর্ডার বলে।

পরিবার ও সমাজে অনেকে এ ধরনের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে জীবন যাপন করছে। রোগীদের অবস্থাও পরিবার বুঝতে পারছে না। ফলে এ রকম রোগীরা নিজেদের একা মনে করেন। এমন রোগীদের পাশে দাঁড়াতে ভারতে কাজ করেছেন বিজয় নালাওয়ালা (৪০) নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেও বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। তাঁর এ উদ্যোগ নিয়ে বিবিসিতে প্রতিবেদন লিখেছেন উর্বশী সরকার।

বিজয় নালাওয়ালা ১৪ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো উপসর্গগুলো টের পেতে শুরু করেন। তবে সে সময় কেউ বুঝতে পারেনি, তাঁর সমস্যাটা কোথায় ছিল। সে সময় তিনি চিকিৎসা সহায়তার খোঁজ করছিলেন। তবে তা সহজলভ্য হয়নি। ২০০৩ সালে ধরা পড়ে বিজয় বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগছেন।

বিজয় হঠাৎ হঠাৎ খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। আবার বিষণ্নতায় ডুবে যেতেন। রাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি হতাশাজনক কবিতা লিখতেন। মনমেজাজ খুব দ্রুত বদলে যেতো

৬০ বছর বয়সী বিজয়ের পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল। গত পাঁচ থেকে ছয় বছর তিনি স্থিতিশীল অবস্থায় আছেন। বিজয় চাইছিলেন, কীভাবে এ মানসিক অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে বিজয়ের মতো নিজেদের একা না ভাবেন। ২০১২ সালে তিনি ব্লগে এ নিয়ে লেখা শুরু করেন। এ ব্লগে বাইপোলার ডিজঅর্ডার নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা হয়। এ ব্লগের সদস্যের সংখ্যা এখন ৫০০ ছাড়িয়েছে। এ ব্লগে এই মানসিক অসুস্থতায় ভোগা রোগীরা পরস্পর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে পারে।

২০১৬ সালে ভারতের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য বলছে, কমপক্ষে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ ভারতীয় বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগছে। তবে লজ্জা ও সচেতনতার অভাবের কারণে রোগীরা নিয়মিতভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। বিবিস
ভারতে মনোবিদের সংখ্যাও কম। ফলে এ ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসার সুযোগও কম পায়।

বিজয়ের প্রতিষ্ঠিত বাইপোলার ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পার হয়েছে। বিজয় এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ টেলিগ্রাম গ্রুপে বাইপোলার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। মুম্বাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও বড় বড় শহরের সদস্যরা নিয়মিতভাবে এ গ্রুপে আলোচনার আয়োজন করে।

বিজয় বলেছেন, তিনি বাইপোলার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সমানুভূতির ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছেন। যারা এ রকম পরিস্থিতিতে রয়েছে, মানসিকভাবে ও আর্থিকভাবে তাদের সহায়তা দিতে চেয়েছেন।

বিজয় আরও বলেন, সচেতন হলে বাইপোলার ডিজঅর্ডারে যারা ভুগছে, তারা আত্মহত্যার মতো চারটি পরিস্থিতি এড়াতে পারে। এ গ্রুপ জরুরি পরিস্থিতিতে বাইপোলার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তাও দেয়।

বিজয় আরও বলেন, স্বাস্থ্যজনিত জ্ঞান কম থাকায় রোগীরা বেশি ভুগতে পারে। ভারতে আইন অনুসারে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোতে মানসিক অসুস্থতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে ইনস্যুরেন্স বা বিমা কোম্পানিগুলো এমন কাজ কমই করে থাকে।

বাইপোলার ইন্ডিয়া এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। বিজয় নালাওয়ালা বলছেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন, পুনর্বাসন ছাড়া মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা কঠিন। ৫৭ বছর বয়সী তৃপ্তি মিশ্রও এ রকম বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। ১৩ চিকিৎসককে দেখিয়েছেন তিনি। তবে কেউই তাঁকে বলেননি, সমস্যাটা আসলে কোথায়। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের বাসিন্দা তৃপ্তি বলেন, ‘আমার ধারণা, চিকিৎসকেরা আমার কথা ভালোভাবে শোনেননি। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমার সঙ্গে ঠিক কী ঘটছে। কেনই–বা এটা ঘটছে।’

তৃপ্তি মিশ্র কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক। তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, মানসিক অসুস্থতার সময় পরিবার তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তৃপ্তি এমনও বলেন, বাইপোলার ইন্ডিয়ায় যোগ দেওয়ার পর তাঁর জীবনটা বদলে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, আমি একা নাই। আমি ভয়, দোষ, নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে এ কমিউনিটিতে আলোচনা করেছি।’

মুম্বাইয়ের বাসিন্দা ভেঙ্কটেশপ্রসাদ নারায়ণ আয়ার ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের ৩১ বছরের মেয়েকে বাইপোলার ইন্ডিয়া ফোরামে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ, তিনি মনে করেন, এই বাইপোলার গ্রুপে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পান। তিনি বলেন, আবেগীয়, আধ্যাত্মিক ও আর্থিক সংকট নিয়ে এ গ্রুপে সবাই কাজ করতে পারেন। এ গ্রুপে সবাই নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারে।

মুম্বাই সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির সাবেক সেক্রেটারি ও মনোবিদ মিরান বালাকৃষ্ণান বলেন, হতাশা বা বিষণ্নতা নিয়ে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি খোলামেলা আলোচনা হয়। তবে তারপরও বিষণ্নতাকে এখনো রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এর নিরাময় নিয়েও আলোচনা কম।

তবে মানসিক অসুস্থতার নিরাময় নিয়ে নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বাইপোলার ইন্ডিয়া গ্রুপ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

Previous articleপ্রিয়জনের নিশ্চিত মৃত্যুতে নিজের মানসিক প্রস্তুতি
Next article‘দেশ জুড়ে মনের খবর’ : সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি, দূর্যোগ ও দূর্ভোগ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here