যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে নারীদের গড় আয়ু ৮২ বছর আর পুরুষের ৭৬ বছর। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, সারা বিশ্বেই পুরুষের তুলনায় নারীরা সাধারণত বেশি দিন বাঁচে। কিন্তু এর পেছনে কারণ কী?
অনেক কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণই বায়োলজিক্যাল বা জীবতাত্ত্বিক। প্রথমটি হচ্ছে, সেক্স হরমোন বা লিঙ্গ নির্ধারক হরমোনবিষয়ক, অন্তত সিসজেন্ডার মানুষদের ক্ষেত্রে। যাদের লৈঙ্গিক স্বকীয়তা বায়োলজিক্যাল সেক্সের সঙ্গে মিলে যায়, তাদের বলা হয় সিসজেন্ডার। তারা হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডারের বিপরীত। সিসজেন্ডার নারীরা সিসজেন্ডার পুরুষের তুলনায় বেশি পরিমাণ ইস্ট্রোজেন এবং কম পরিমাণ টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদন করে। ২০১৭ সালে ‘বায়োলজি অব সেক্স ডিফরেন্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, ইস্ট্রোজেন হরমোন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজসহ বেশ কিছু রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। অন্যদিকে ২০২০ সালে নেচার মেডিসিন–এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, উচ্চমাত্রার টেস্টোস্টেরন নারীদের এন্ডোমেট্রিয়াল (জরায়ুর ভেতরের আস্তরণ) ও স্তন ক্যানসার এবং পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। টেস্টোস্টেরন ঝুঁকিপূর্ণ ও আগ্রাসী আচরণের শঙ্কাও বাড়ায়। যে কারণে অল্প বয়সে মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
জেনেটিক উপাদানও নারীর বেশি আয়ুর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের সেক্স ক্রোমোজোম দুটি—X ও Y। সিসজেন্ডার নারীর থাকে দুটি X ক্রোমোজোম। পুরুষের X ও Y ক্রোমোজোম থাকে একটি করে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের ডেমোগ্রাফিক বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ভার্জিনিয়া জারুলি বলেন, ‘আপনি যদি এভাবে দেখেন যে একটি Y ক্রোমোজোম একটি X ক্রোমোজোমের মতোই, যার আদতে একটা ‘পা’ নেই। তার মানে Y ক্রোমোজোমে জেনেটিক উপাদান তুলনামূলক কম। নারীদের দুটি X ক্রোমোজোম আছে, তার মানে তাদের জেনেটিক উপাদান আছে বেশি। নারীদের দুটি X ক্রোমোজোম থাকার কারণে একটিতে যদি কোনো সমস্যাও হয়, তাহলে ব্যাকআপ হিসেবে থাকে আরেকটি। যা নারীর বেশি আয়ুর পেছনে ভূমিকা রাখে।’
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, পাখির মধ্যে পুরুষের এক্স ক্রোমোজোমের দুটি কপি থাকে। ফলে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। ১৮৯০-১৯৯৫ সালের মধ্যে জীবিত ছিলেন এমন ১১ হাজার ক্যাথলিক নারী ও পুরুষ সন্ন্যাসীর ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষের তুলনায় গড়ে এক বছর বেশি বেঁচেছেন। সন্ন্যাসীদের ওপর গবেষণার যুক্তি হচ্ছে, নারী-পুরুষ উভয়ই এখানে কড়া ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে জীবনযাপন করেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজও চলেন এড়িয়ে। অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও জীবনযাপনের ধারা বাদ দিলেও পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি দিন বাঁচে। জারুলির মতে, নারীর দীর্ঘায়ুর ব্যাপারটি তাই প্রাকৃতিক। যদিও এই গবেষণায় সন্ন্যাসীদের আয়ু জন্ম থেকে হিসাব করা হয়নি, হিসাব করা হয়েছে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থা থেকে। তাই নারী-পুরুষের গড় আয়ুর পার্থক্য আরও বাড়তে পারে।
আবার শিশুরা যখন মহামারি ও দুর্ভিক্ষের মতো বিরূপ পরিবেশে থাকে, তখনো ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুর টিকে থাকার হার বেশি। ২০১৮ সালে ‘প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এটি বলা হয়েছে। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ভার্জিনিয়া জারুলি।
নারীরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৪-৫ বছর বেশি বাঁচে। তাহলে এর পেছনে আর কী কী কারণ আছে? জারুলির মতে, সামাজিক ব্যাপারটি এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। পুরুষ সাধারণত নারীর তুলনায় বেশি ধূমপান এবং অ্যালকোহল গ্রহণ করেন। পুরুষের তুলনায় নারীরা পুষ্টিকর খাবারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়। আর সাধারণত চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড ইত্যাদির প্রতি পুরুষদের ঝোঁক বেশি। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতার ক্ষেত্রেও (গর্ভধারণ জটিলতার বাইরেও) পুরুষের তুলনায় নারীরা ৩৩ শতাংশ এগিয়ে।
তবে বর্তমানে নারী-পুরুষের গড় আয়ুর যে পার্থক্য, এর আগে কখনোই এতটা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুসারে, পার্থক্যটা শুরু হয়েছে বিশ শতক থেকে। এর আগে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে নারী-পুরুষ উভয়ই গণহারে মারা যেত। আবার সন্তান জন্মদানের সময়ও অনেক নারী মারা যেত। তবে এখন চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির পর নারীদের গড় আয়ু যতটা বাড়তে পারত, বাস্তবে ততটা বাড়েনি। এর একটি কারণ, নারীরাও এখন ধূমপান করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের তথ্যমতে, ২০০৫ সাল পর্যন্ত নারীরা তাদের সম্ভাবনাময় গড় আয়ুর তুলনায় দুই বছর তিন মাস কম বেঁচেছে। কারণ, এ সময়টা প্রচুরসংখ্যক নারী ধূমপায়ী হতে শুরু করেছে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে