অনলাইন সাহিত্য গ্রুপে একটি গল্প পড়ছিলাম। সদ্য মা হওয়া একজন তরুণী রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তার নবজাতকের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর সবাই বাচ্চাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করছে। তার দিকে কারো নজর নেই। দিন কয়েক পরে শিশুটিকে মৃত অবস্থায় তার বিছানায় পাওয়া গেল। গলায় হাতের আঙুলের ছাপ। পাশে ভাবলেশহীন মা। সমাজের চোখে এক ডাইনি মা। আমাদের সচেতনতা, চারপাশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা হয়ত এ ডাইনি মাকে একজন অসাধারণ মমতাময়ী মা হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত করতে পারত। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, আমি কথা বলছিলাম ‘ইনফ্যান্টিসাইড’ নিয়ে। প্রসূতিদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম ভয়াবহ একটি পরিণতি। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় চার শতাংশ শিশু প্রসব পরবর্তী মানসিক রোগে ভোগা মায়ের হাতে মৃত্যুবরণ করে অথবা ঝুঁকিতে থাকে। আমেরিকায় ২০১২ সালে ফরেনসিক বিভাগের NGRI ( Not Guilty by Reason of Insanity) এক হিসাব মতে দেখা যায়, প্রতি বছর যত শিশু এক বছর বয়সের মধ্যে মায়ের হাতে মৃত্যু বরণ করে সেসব মায়েদের ৭২% আগে থেকেই মানসিক রোগে আক্রান্ত, ৪৯% ঐ সময়ে বিষণ্নতায় ভুগছিলেন, ৬৯% এর কানে গায়েবি কথা (অডিটরি হ্যালুসিনেশন) শুনতেন এবং ৮২ শতাংশের সাইকোসিস অথবা আবেগজনিত রোগের সঙ্গে সাইকোসিসের লক্ষণযুক্ত ছিল। গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর উভয় সময়েই মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আজ আমরা আলোচনা করব প্রসব-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। এ সময়ে সাধারণ ম্যাটারনিটি ব্লু থেকে গুরুতর মানসিক রোগের শুরু হতে পারে। যেমন- ম্যাটারনিটি ব্লু (Maternity Blue/Post-Partum Blue) প্রায় দুই তৃতীয়াংশ প্রসূতি ম্যাটারনিটি ব্লুতে আক্রান্ত হন। খিটখিটে মেজাজ, অল্পতেই বিরক্তি, এই হাসি এই কান্না, দ্রুত মুড পরিবর্তন হওয়া, উদ্বেগ, দুঃখবোধ, মনোযোগ কমে যাওয়া, ঘুম ও খাবারের সমস্যা, ভারাক্রান্ত মন ইত্যাদি উপসর্গ এই সময়ে দেখা যায়। প্রসবের তিন/চারদিনের মধ্যে লক্ষণগুলো সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পৌঁছে এবং ২-৩ দিন থেকে সর্বোচ্চ দুসপ্তাহের মধ্যে আস্তে আস্তে তা চলে যায়। সধারণত কোনো চিকিৎসা দরকার হয় না।
- প্রসব-পরবর্তী মুড ডিজঅর্ডার বা আবেগজনিত রোগ (Post-Partum Depression)
- প্রসব-পরবর্তী সাইকোসিস (Post-Partum Psychosis)
- উদ্বেগজনিত রোগ (Anxiety Disorder)
- খাবারের সমস্যাজনিত মানসিক রোগ (Eating Disorder)
- পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (Post Traumatic Stress Disorder)
এছাড়াও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা: বাচ্চার জন্মের পরপর স্বল্প মাত্রার বিষণ্নতা অনেক বেশি দেখা যায়, গবেষণায় দেখা গিয়েছে ৫ শতাংশের মধ্যে প্রসবের পরবর্তী সময়ে গুরুতর বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। এ বিষণ্নতার লক্ষণগুলো প্রাথমিকভাবে বেবি ব্লুয়ের মতো মনে হলেও এগুলোর তীব্রতা বেবি ব্লু থেকে অনেক বেশি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি হয়। সাধারণত প্রসবের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হয় তবে কখনো কখনো গর্ভাবস্থার শেষদিকেও শুরু হতে পারে। যেসব লক্ষণ বেশি দেখা যায় তা হচ্ছে- বিষণ্নতা কিংবা মুড সুয়িং, অতিরিক্ত কান্না, শিশুর সঙ্গে বন্ধন তৈরিতে সমস্যা, পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের থেকে বিছিন্নবোধ করা, খাবারে অরুচি অথবা অতিরিক্ত খাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া অথবা অতিরিক্ত ঘুমানো, শরীরে শক্তি না পাওয়া, অল্পতেই ক্লান্তি লাগা, আনন্দদায়ক কাজে আগ্রহ কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ ও দ্রুত রেগে যাওয়া, নিজে একজন ভালো মা হতে না পারার ভয়, হতাশ অনুভব করা, অকারণে লজ্জা ও গ্লানি অনুভূত হওয়া, অস্থিরতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা, দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, নিজের বা নবজাতকের ক্ষতি করার চিন্তা, বারবার আত্মহত্যার চিন্তা আসা বা আত্মহত্যার চেষ্টা করা। তবে সবার মধ্যে সব লক্ষণ থাকবে তা নয়।
প্রসবোত্তর সাইকোসিস: যদিও এটি খুব একটা দেখা যায় না (প্রতি ১০০০ প্রসবে ১-২ জনের হয়) কিন্তু কেউ আক্রান্ত হলে অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে। সাধারণত সন্তান জন্ম দানের পরপরই অর্থাৎ ২-৩ দিন থেকে ২/১ সপ্তাহের মধ্যেই সাইকোসিসের লক্ষণ শুরু হয়। হঠাৎ শুরু হয় এবং খুব দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে। লক্ষণগুলো সাধারণত বিভ্রান্ত (কনফিউশন) এবং স্থান-কাল-পাত্র বুঝতে না পারা (ডিজওরিয়েন্টেশন), শিশুর বিষয়ে অবসেশান, হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন, অত্যধিক শক্তি দেখানো বা অস্থিরতা, ঘুমের সমস্যা, সন্দেহ প্রবণতা, নিজের অথবা বাচ্চার ক্ষতি করার চেষ্টা এমনকি নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলার মতো গুরুতর ভুল কাজ করে বসতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু হলে ৭৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই রোগী পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে ৭০ ভাগ রোগীর পরবর্তী গর্ভধারণের সময় আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
কী কারণে এমনটি হয়?
আর দশটি মানসিক রোগের মতোই এসময়ের মানসিক রোগের একক বা সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। গর্ভাবস্থা বা প্রসবের পরে নতুন করে যেমন মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে তেমনি আগে থেকে যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন তাদের সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সম্ভাব্য যেসব কারণ এ পর্যন্ত জানা গিয়েছে সেসব হচ্ছে-
হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন: শিশুর জন্মের পরপরই মায়ের শরীরে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন নামক দুটি হরমোনের নিঃসরণ খুব দ্রুত কমে যায় ফলে তা প্রসূতির বিষণ্নতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও থাইরয়েড হরমোনের দ্রুত কমে যাওয়ার কারণে ক্লান্তিবোধ ও ধীরগতি চলে আসে।
আবেগজনিত কারণ: শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মাকে এক নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। দেখা যায়, নিজের অসুস্থ শরীরের পাশাপাশি নবজাতকের খাবার নিশ্চিত করা এবং রাত জেগে বাচ্চার যত্ন নিতে গিয়ে মা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না, নিজের পর্যাপ্ত পরিমাণ যত্ন আর বিশ্রামও হচ্ছে না। পাশাপাশি নিজের সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বেগ, বাচ্চা ঠিকমতো প্রতিপালন নিয়ে দুশ্চিন্তা ইত্যাদিও আছে। এছাড়াও দেখা যায়, অনেক সময় আশেপাশের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটি। মায়ের প্রয়োজন বা আবেগের দিকে অন্যদের সেভাবে দৃষ্টি দেয়া হয় না। যার ফলে মা একধরনের একাকিত্বে ভোগেন ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠেন। আবার কখনো নবজাতকের প্রতি অকারণ ঈর্ষা এবং বিদ্বেষ তৈরি হয়। নিজর আইডেন্টিটি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ হারান। এছাড়াও কিছু ঝুঁকপূর্ণ বিষয় আছে। যেমন-
- অতীতে কেউ যদি মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন অথবা আগেও গর্ভাবস্থায় বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে থাকলে।
- মানসিক রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে।
- আগে কোনো মানসিক চাপে ভোগার ইতিহাস
যেমন- অনিচ্ছুক কিংবা অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, আগের গর্ভাবস্থায় কোনো শারীরিক অসুস্থতা, স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা, কোনো ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হওয়া, চাকুরিস্থলে জটিলতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা, নবজাতকের সমস্যা, ঠিকমতো মায়ের দুধ পান করাতে না পারা, বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশে কন্যা সন্তানের মা হওয়া ইত্যাদি। প্রসব-পরবর্তী সময়ে নিকটজনের থেকে কাঙ্ক্ষিত মানসিক ও অন্যান্য সাহায্য না পাওয়া। মতৃ শিশু বা সাধারণের চেয়ে ভিন্ন শিশুর জন্ম দেয়া ইত্যাদি পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রভাব: একজন মায়ের প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যা শুধু তার ওপরই নয়, বরং পুরো পরিবারের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
মায়ের ওপর: যদি দ্রুত সঠিক চিকিৎসা না পান তবে মায়ের প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং পরের গর্ভকালীন সময়ে কিংবা গর্ভাবস্থা ছাড়াও বারবার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তীব্র বিষণ্নতা কিংবা সাইকোসিসে আক্রান্ত মা নিজের জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি বাচ্চার জন্য হুমকি। বাচ্চার যত্নের অবহেলা থেকে শুরু করে নিজের সন্তানকে হত্যা করার মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটাতে পারেন।
বাবার ওপর: প্রসূতির মানসিক রোগ, বিশেষ করে বিষণ্নতার প্রভাব তার সঙ্গীর ওপরও পড়তে পারে। অর্থাৎ তিনিও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
শিশুর ওপর: মায়ের মানসিক রোগ শুধু শিশুকালেই নয় বড়ো হওয়ার পরেও এর প্রভাব সন্তানের ওপর থাকতে পারে। পরবর্তী জীবনে এদের আবেগজনিত ও আচরণগত মানসিক রোগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা অন্য শিশুদের থেকে বেশি থাকে। অতিরিক্ত কান্না, খাওয়া ও ঘুমের সমস্যা হয় এবং তাদের স্বাভাবিক বিকাশও ব্যাহত হতে পারে।
প্রতিরোধ
যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। অর্থাৎ রোগটি যাতে না হয় সে বিষয়ে সম্ভাব্য ব্যবস্থা নেয়া।
যেমন, আপনি যদি আগে থেকেই কোনো প্রকার মানসিক রোগে ভোগেন কিংবা মানসিক রোগের জন্য ওষুধ সেবন করছেন এমন হয় সেক্ষেত্রে গর্ভধারণের পূর্বেই আপনার চিকিৎসক অর্থাৎ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন।
এছাড়াও গর্ভকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে কোনো লক্ষণ শুরু হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। আগে থেকে কোনো ওষুধ পেয়ে থাকলে তা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আবার কমানো/বাড়ানো/পরিবর্তন/বন্ধ করা যা প্রয়োজন করতে হবে। লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করা। জানামতে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় থাকলে তার দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন।
শিশুর বিশেষ যত্নঃ মা যদি গুরুতর বিষণ্নতা বা সাইকোসিসে ভোগেন/আক্রান্ত হন তবে শিশুকে বুকের দুধ পান করানোসহ সার্বক্ষণিক দায়িত্বশীল অন্য কারো তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের কাছ থেকে আলাদা রেখে যত্ন নিতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
দু-সপ্তাহের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ কমছে না বরং অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে, নিজের এবং বাচ্চার যত্ন ঠিকমতো নিতে অক্ষম হচ্ছেন, নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তা বারবার আসছে কিংবা বাচ্চার ক্ষতি করার ইচ্ছে জাগছে। এমন হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বাসায় নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। আসুন আমরা গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয় খাতেই সমান মনোযোগ দেই, সচেতন হই। মা ও শিশুর স্বাভাবিক স্বাস্থ্য স্থিতিশীল রাখি।
ডা. শাহানা পারভীন
সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে