ছোট্ট শিশু লামিরা, বয়স পাঁচ মাস। কী আরাম করেই না সে মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছে! মা তাকিয়ে দেখে অসম্ভব ভালো লাগার সঙ্গে কাজ করে একটা আতঙ্ক। আর কিছুদিন পরই চাকরিতে যোগদান করতে হবে, মাতৃত্বকালীন ছুটির ছয় মাস প্রায় শেষ হতে চলল। কোথায় রেখে যাবেন লামিয়াকে! ইশ, যদি মা অথবা শাশুড়ি সঙ্গে থাকতেন! তবে তার অবর্তমানে লামিয়ার যত্নের কোনো কমতি হতো না। তার এই একক পরিবারে বাসার কাজে সাহায্যকারী মেয়েটাই ভরসা। কিন্তু কতটুকু বিশ্বস্ত সে? কতটুকু পারদর্শী? নানা চিন্তা, ভয়, অনিশ্চয়তা একসঙ্গে গ্রাস করে মা লামিয়াকে। সময়ের পালাবদলে বর্তমানে মায়েরা অনেক বেশি কর্মজীবী এবং বহির্মুখী। অপরদিকে যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার ফলে শিশুর প্রতিপালনে তারা অনেকটা নিরুপায়ও। সন্তানকে রাখার অসুবিধার কারণে একক পরিবারের অনেক নতুন মাকে কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দিতে হয় শুধু সন্তান দেখাশোনার সুবিধার্থে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্বিক বিকাশের সঙ্গী হতে পারে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার সেন্টার।
বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭৫ সালে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলায় তিনটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ইউনিসেফ। পরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে বিভিন্নভাবে। যেমন- সরকারি পর্যায়ে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১৯টি এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশে শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন বা তার বেশি নারী কাজ করে সেসব প্রতিষ্ঠানে ছয় বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থা বর্তমানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। আর বেসরকারি উদ্যোগে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করতে উৎসাহিত করা এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন ২০২১’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এ আইন অনুযায়ী যেমন অনুমোদনহীন শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিকল্পনা করা যাবে না তেমনি শিশুর নিরাপত্তার লক্ষ্যে কর্তব্যে অবহেলা ও শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হলে বা কেন্দ্র থেকে শিশু হারিয়ে গেলে সর্বোচ্চ ১৩ বছর কারাদন্ডের পাশাপাশি পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। যদিও অনস্বীকার্য, সরকারি-বেসরকারি এত উদ্যোগের পরও বাংলাদেশে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা অতি নগণ্য। যদিওবা কিছু সংখ্যক ডে কেয়ার বিদ্যমান সবগুলোর মান আশানুরূপ নয়। একটি ভালো মানের ডে কেয়ারে ট্রেনিংপ্রাপ্ত পরিচর্যাকারী থাকা অবশ্যই প্রয়োজন যা বেশিরভাগ ডে কেয়ারে পরিলক্ষিত হয় না।
সাধারণত ৬ মাস থেকে ৬ বছর পর্যন্ত যেকোনো বয়সেই একটি শিশু ডে কেয়ারে থাকতে পারে এবং দিনের একটি বড়ো সময় সেখানে পার করে। এই বয়সকালটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের আদর্শ সময়। আর তাই ডে কেয়ারগুলোর কর্মপরিসরে শিশুর দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা যেমন সময়মতো খাওয়া ঘুম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকতে হবে তেমনি তার সার্বিক বিকাশের দিকে নজর দেয়াটাও অতি প্রয়োজনীয়। তবে ভালো মানের ডে কেয়ারের অভাবে অনেক সময় শিশু-নির্যাতন, সংক্রমণ-রোগের মতো ঝুঁকির দিকগুলো সবার আগে মাথায় আসে। অনেকেই মনে করেন ডে কেয়ারে বাচ্চা বড়ো হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় হয় না। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, একটি আদর্শ ডে কেয়ারে বাচ্চা যেমন পরিচর্যার পাশাপাশি সামাজিক, নৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়; মা-বাবা তেমন নির্ভাবনায় নিজ কর্মদক্ষতা দেখিয়ে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে শিশুটিকে বড়ো করতে পারেন। সেইসঙ্গে ছুটির দিনসহ ডে কেয়ারের বাইরের সময়টুকুতে পরিবারে কিছু কোয়ালিটি সময় কাটিয়ে বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে পারেন। যা অস্থিরতা আর অস্বচ্ছলতায় ডুবে থাকা বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। একটি আদর্শ ডে কেয়ার প্রি-স্কুলের ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- শিক্ষণীয় কার্যকলাপের পাশাপাশি গল্প বলা, গান, কবিতা, নাচ, ছবি আঁকা, ক্রাফট ইত্যাদিসহ বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিবস পালন করে শিশুর বিকাশকে সমুন্নত করতে পারে।
অন্যদিকে মা-বাবাও নির্ভাবনায় তাদের কর্মদক্ষতার পুরোটাই কর্মক্ষেত্রে দিতে পারেন। যা তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সহায়তা করে। উল্টোভাবে চিন্তা করলে শিশুর যত্ন নিয়ে যদি সবসময় বাবা-মাকে চিন্তা করতে হয় কাজের জায়গাতে তারা তাদের সর্বোচ্চটুকু দিতে পারেন না। তারা বিমর্ষ থাকেন। বাসায় এসে লালন পালনের ক্ষেত্রে তার ছাপ পড়ে। উভয় দিক সামলাতে যেয়ে হিমশিম খেয়ে অনেকে এরকম পরিস্থিতে একটি দিক ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবেন। অথবা আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে কাজটি চালিয়ে গেলেও বাচ্চা এবং কর্মক্ষেত্র উভয়দিকেই এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর তাই একটি আদর্শ ডে কেয়ার সর্বোপরি হতে পারে মা-বাবার নির্ভরতার সঙ্গী।
ডা. সামিনা হক
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে