শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাপ শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি নষ্ট করে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাপ শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি নষ্ট করে?

শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটে যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে। ঢাউস সাইজের একটা ব্যাগ কাঁধে করে স্কুল-কলেজ থেকে ফিরে (কিংবা এই প্যান্ডেমিকের সময়ের জুম-যাপন শেষ করে), প্রাইভেট-কোচিংয়ে সময় দিয়ে, হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে দিন শেষ হতে না হতেই পরবর্তী দিনের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়।

এরই মাঝে পরীক্ষা আসে এই টেস্ট, সেই টেস্ট। এসব পরীক্ষায় ভালো করার জন্য নিতে হয় অতিরিক্ত প্রস্তুতি। থাকে রেজাল্ট ভালো করার চাপ। সকলকে পেছনে ফেলে সেরা হওয়ার চাপ।

শিক্ষা যে আনন্দের বিষয়ও হতে পারে এত সবের চাপাতলে পড়ে একটা বিশাল পরিমাণ শিক্ষার্থীদের মানসপটে সেই উপলব্ধিটাই জন্মায় না। যদিও আপাত- দৃষ্টিতে পড়াশোনা বিষয়ক এসব চাপকে স্বাভাবিক বলেই মনে হতে পারে।রেজাল্ট ভালো করতে হবে না? চাপ তো নিতেই হবে! কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার মূল্যায়ন বা গতি- প্রকৃতি বোঝার জন্য রেজাল্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সূচক হলেও রেজাল্ট ভালো করা পড়াশোনার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের অনিসন্ধিৎসু মনের দেখভাল করা, তাদের মাঝে জ্ঞানের তৃষ্ণা তৈরি করা, একটি বিশ্লেষণাত্মক, সৃজনশীল, স্বাধীন চিন্তাক্ষম মন তৈরি করার পাশাপাশি জীবনযাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো শেখানো।

সে যাই হোক, আপাতত আমরা ধরে নেই যে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আসলে শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাধীন চিন্তার বীজ বপন করারই চেষ্টা করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এজন্য কোন পরিবেশটা আসলে উপযুক্ত চাপমুক্ত নাকি চাপযুক্ত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে চলে আসছে স্বাধীন চিন্তাক্ষমতা বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে?

স্বাধীন চিন্তা বলতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বোঝানো হচ্ছে। যেকোনো বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারা বা ক্রিয়েটিভ থিংকিং অ্যান্ড রাইটিং, কোনো বিমূর্ত ধারণা বা সমস্যার সমাধান করা। যেমন একই অংকের সমাধানে যে নানা উপায়ে পৌঁছানো যায় সেটা বুঝতে পারা, নিজের কল্পনার জগৎ বা মেন্টাল ম্যাপ ব্যবহার করতে পারা এসবই স্বাধীন চিন্তাক্ষমতা। একদম সহজ করে বললে, স্বাধীন চিন্তাক্ষমতা হচ্ছে মাথা খাঁটিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান বা নতুন কিছু তৈরি করতে পারার ক্ষমতা।

আমাদের সকলেরই বোধ হয় এমন অভিজ্ঞতা আছে যখন আমাদের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। হয়ত কোনো ভাইভা ইন্টারভিউয়ে জানা জিনিস পারিনি কিংবা পরীক্ষার মধ্যে খুবই সহজ কোনো অংকের সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু বাসায় নির্ভার হয়ে সেই একই অংক খুব সহজেই করতে পেরেছি। সুতরাং নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা বলতে পারি, কগনিটিভ বা বুদ্ধিভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে মানসিক চাপের একটা ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

এখান থেকে মনে হতে পারে রিল্যাক্স বা নির্ভার থাকলে হয়ত আমরা খুব সহজেই বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারব। অর্থাৎ আমাদের সৃজনশীলতা বেড়ে যাবে। এই মনে হওয়াটা পরীক্ষা করার জন্য আমেরিকার রাইডার ইউনিভার্সিটির এডুকেশনাল সাইকোলজির প্রফেসর জন বেয়ার ১৯৯৮ সালে একটি এক্সপেরিমেন্ট করেন।

প্রথমেই শিক্ষার্থীদের দুটি দলে ভাগ করে ফেলা হয়। এই ভাগটি র‌্যান্ডম বা দৈবভাবে করা হয়, যাতে দুই দলেই মেধাবী বা সৃজনশীল শিক্ষার্থীরা সমভাবে বণ্টিত হয়। উভয় দলকেই একই ধরনের কাজ বা সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হয়।

পার্থক্য হচ্ছে, একটি দলকে বলা হয় তাদের কাজ মূল্যায়ন করা হবে। আরেকটি দলকে বলা হয় তারা খেলাচ্ছলে এসব কাজ করতে পারে। মূল্যায়নের কোনো চাপ নাই। দেখা যায়, যারা নির্ভার হয়ে কাজগুলো করেছে তাদের চেয়ে বরং মূল্যায়নের চাপ মাথায় নিয়ে কাজ করা দলটির পারফরম্যান্স ভালো। যার অর্থ দাঁড়ায়, চাপের ফলে সৃজনশীলতা বেড়ে গেছে।

ওপরে উল্লিখিত দুইটি প্রেক্ষাপটের (চাপের ফলে সৃজনশীলতা কমে যাওয়া আবার চাপের ফলে সৃজনশীলতা বেড়ে যাওয়া) পেছনেই সায়েন্টিফিক থিওরেটিক্যাল ভিত্তি আছে। আমি খুব সহজ করে বলছি আমাদের মানসিক কার্যক্ষমতা বা কগনিটিভ রিসোর্স হচ্ছে সীমিত।

আমরা যখন চাপে থাকিÑযেমন ভাইভা বোর্ডে বা পরীক্ষার হলে তখন মানসিক কার্যক্ষমতার কিছু অংশ সেই চাপ মোকাবেলায় ব্যয় হয়ে যায়। যার ফলে বাকি স্বল্প পরিমাণ কার্যক্ষমতা নিয়ে আমরা আশানুরূপ ফলাফল করতে পারি না।

সৃজনশীলতা কমে যায়। আবার চাপে পড়লে আমাদের মস্তিষ্কে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। মস্তিষ্কের অ্যালার্টনেস এবং অ্যাক্টিভিটি বেড়ে যায়। সেই চাপ প্রশমন করার জন্য ব্রেইন নানান উপায় বা শর্টকাট খুঁজতে থাকে বলে আমাদের সৃজনশীলতা যায় বেড়ে।

সুতরাং দুই ধরনের ঘটনাই ঘটে। বিপদে পড়লে যেমন-ব্রেইন ফ্রিজ হয়ে যায় আবার বিপদে পড়লে ব্রেইন খুলেও যায়। কিন্তু কখন কোনটা ঘটে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাহলে বিষয়টা কী হবে?

এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা একদল মার্কিন গবেষকদের দ্বারস্থ হব। উনারা ২০১০ সালের দিকে সে যাবৎকালের চাপ এবং সৃজনশীলতা বিষয়ক সকল গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে দেখান যে চাপ আর সৃজনশীলতার সম্পর্কটা আসলে সরলরৈখিক না, বক্ররৈখিক।

এর অর্থ হচ্ছে, শূন্য চাপে সৃজনশীলতা কম থাকে। চাপ বাড়াতে থাকলে সৃজনশীলতা বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই চাপ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হয়ে গেলে সৃজনশীলতা আবার কমতে থাকে। সেই সঙ্গে চাপের ধরন এবং প্রেক্ষাপটেরও ভূমিকা আছে।

ব্যক্তির যদি সেই চাপ মোকাবিলা করার মতো কগনিটিভ রিসোর্স থাকে, তবে তার সৃজনশীলতা বেড়ে যাবে। কিন্তু সেই চাপ মোকাবিলা করা যদি তার সামর্থ্যরে বাইরে হয়, তবে তার ব্রেইন ফ্রিজ হয়ে যাবে এবং ব্যক্তিকে যদি এই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা লেভেলের চাপ সার্বক্ষণিক দেয়া হয়, তবে তার নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার সূত্রপাত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগামহীন চাপ কখনোই কাম্য নয়। লাগামহীন চাপ আসলেই শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তাক্ষমতা নষ্ট করছে। একই সঙ্গে কোনো রকম চাপ না থাকাও আবার কাম্য না। বরং নিয়মতান্ত্রিকভাবে বা সিস্টেমেটিকালি শিক্ষার্থীদের স্বল্প পরিসরে চাপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করা উচিত।

যেখানে কিনা শিক্ষার্থীরা সক্ষম হবে প্রদানকৃত চাপ প্রশমন করতে। চাপ থাকলেও, সেই চাপ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় তাদের হাতেই থাকবে। খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন চাপের কারণে বিহ্বল বা দিকশূন্য না হয়ে পড়ে। বরং চাপ মোকাবিলা করার পর তারা যেন ইতিবাচক ফলাফল পায়।

ফিরোজ শরীফ

মনোবিদ।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমনোবল বাড়িয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পাঁচটি উপায়
Next articleপুরুষের হরমোন (টেস্টোস্টেরন) ঘাটতি বুঝার উপায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here