শ্বশুড়বাড়িতে মেয়েদের মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা ও করণীয়

শ্বশুড়বাড়িতে মেয়েদের মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা ও করণীয়

বর্তমান সমাজের বহুল আলোচিত সামাজিক এবং পারিবারিক সমস্যার নাম শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে না পারা। এই মানিয়ে নিতে না পারার থেকেই মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি, মুখ দেখাদেখি বন্ধ কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

একটা সমাজ ব্যবস্থা কেমন তা খুব ভালোভাবে বোঝার জন্য প্রচলিত কিছু ধারণা বা শ্লোক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বিজ্ঞান যেভাবে এগোয় আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কিংবা ধারণাগুলো সেভাবে অগ্রসর হয় না। অনেক সময় আমরা প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যাই কিন্তু সামাজিক চিন্তা চেতনায় থেকে যাই মধ্যযুগীয়। অনেক সময় আমরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হই কিন্তু মানসিকভাবে থাকি পরাশ্রয়ী।

আমাদের সমাজে একটি বহুল প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে ”মেয়েরা কিন্তু বিয়ে বসে এবং ছেলেরা কিন্তু বিয়ে করে”।কথাটির প্রচলন হয়েছিলো বোধহয় পুরুষের সক্ষমতা মহিলাদের চেয়ে বেশি কিংবা অহংকার প্রকাশের নিমিত্তে।মূল ব্যাপারটা হচ্ছে বিয়ে মানে দুটো পরিবারের বন্ধন, আত্নীয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক আইনী সম্পর্ক স্থাপন। বিয়ে পরবর্তী সময়ে মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে চলে আসার পরে সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে আসে যেখানে মানিয়ে নেবার সক্ষমতায় অনেকের ঘাটতি থাকতে পারে কিন্তু অধিকাংশ সময় স্বামী, শ্বাশুড়ি, শ্বশুর, ননদ কিংবা অন্যান্য আত্নীয় স্বজনের দ্বারা এমন কিছু ব্যাপার সামনে চলে আসে যা একজন মেয়ের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর।

অস্থিরতা, বিষণ্ণতা, রুপান্তর রোগ’সহ অসংখ্য সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন বহির্বিভাগে অনেক ভদ্রমহিলারা আসেন।যাদের ইতিহাস নেওয়ার সময় মাঝে মাঝে আমার নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে যায়।

ঘটনা
সেদিন একজন ভদ্রমহিলা আমার কাছে আসলেন স্বামীর সাথে। বয়স ২৪। সমস্যার কথা বলা শুরু করলেন তার স্বামী। মেজাজ খিটখিটে,রাগ বেশি ইত্যাদি সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। হঠাৎ ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন ছেলের বউ স্বামীর আগে খেয়ে ফেললে যদি তাকে হাভাতে বলা হয় তাহলে কি রাগ করা উচিত কিনা? আমি বুঝলাম সমস্যা কোথায়? অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে এই মহিলা হয়তো তার বাবার কাছে ছিলো রাজকন্যা, ভাইয়ের কাছে আদরের পুতলা এবং মায়ের কাছে ছিলো চাঁদের আলো। কিন্তু শখ আহ্লাদ তো দূরের কথা এখন তাকে কথা শুনতে হচ্ছে খাওয়ার জন্যে। পরবর্তী ১০ মিনিট খুব দ্রুত এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ভদ্রমহিলা বলে গেলেন তার সমস্যার কথাগুললি।

দায়িত্ব সবসময়ই সবার। কোন কিছু ঠিক করার বা কোন সম্পর্ক ধরে রাখার দায়িত্ব কারো একার নয়। মনে রাখতে হবে যে প্রত্যেক বউমা একদিন শ্বাশুড়ি হবে এটা যেমন সত্য ঠিক সেভাবেই প্রত্যেক শ্বাশুড়ি একদিন বউমা ছিলো।

আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রথম শর্ত হলো আলোচনা। নববধূর মানসিক অবস্থা বিবেচনায় স্বামী এবং তার পরিবারের কিছু ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সংক্ষেপে তাকে এভাবে বলা যায়:

১.ছেলের বউয়ের পারিবারিক একান্ত ব্যাক্তিগত কোন ব্যাপারে শ্বশুরবাড়ির কারো কোন মন্তব্য করা উচিত নয়।দাবী থেকে বলা যায় কিন্তু তার আগে নতুন পরিবেশে তাকে ধাতস্থ হবার সময় দিতে হবে।

২.স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারে কিংবা চাওয়া পাওয়ার কোন ব্যপারে ছেলে মেয়ে কারো বাসা থেকেই কোন অযাচিত সমালোচনা কিংবা মন্তব্য করা অনুচিত।

৩.শিখোনি কেন? পারো না তাই না? কিংবা এগুলি না জানলে কি হবে এমন মন্তব্য না করাই ভালো। ইতিবাচক মন্তব্য তার বাবার মায়ের থেকে দূরে থাকার কষ্টটা কমিয়ে দিবে। শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক সহজ করে দিবে।

৪.কোন প্রকার দেনাপাওনার কথা তোলা অনুচিত এবং আইনবিরোধী। ছেলের বউকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সময় দিতে হবে।অন্যদিকে বাড়ির নতুন বউ এবং পরিবারের সদস্য হিসেবে সময় নিতে হবে কোন মন্তব্য করার জন্যে। সময় দিতে হবে শ্বশুরবাড়ির মানুষের সাথে।

৫.দু’পক্ষই কারো সামাজিক অবস্থান কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলাপ করা, কথায় অহংকারী মনোভাব প্রকাশ না করাই ভালো হবে। স্বামীকে এক্ষেত্রে দুপক্ষকেই সমানভাবে সময় দিতে হবে।

৬.প্রয়োজন আলোচনার। চাওয়া পাওয়া,হতাশা কিংবা জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে শ্বশুরবাড়ির সাথে খোলামেলা আলাপ করা উচিত।

৭.বিয়ের পর থেকেই নিজস্ব দায়িত্ব এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই চিন্তা করতে হবে। সময় দিতে হবে প্রয়োজনের সময়। পছন্দ এবং অপছন্দের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

৮.স্ত্রী যদি চাকুরিজীবী হোন সেক্ষেত্রে সাংসারিক দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া উচিত। উভয়ের ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত খবরদারি কিংবা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা খারাপ হতে পারে। স্ত্রীর অর্জিত অর্থের ব্যাপারে শ্বশুরবাড়ির অনভিপ্রেত মন্তব্য না করাই উচিত।

৯.ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা বাদ দিয়ে পারিবারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে উভয়েরই মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন আছে। অনেকের কাছেই এসব আলোচনা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু জীবন মাঝে মাঝে খুবই নির্মম। মন মাঝে মাঝে অবাধ্য এবং নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নিয়মে নাও থাকতে পারে। জীবনের সুস্থ বিকাশে সাংসারিক সুস্থতা এবং ভালবাসা প্রয়োজন। অনেক মানসিক সমস্যার তৈরী হয় কেবলমাত্র শ্বশুরবাড়ির সাথে দূরত্ব থেকে কিংবা মতের মিল না হওয়ায়। হয়ে যায় নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা কিংবা বিচ্ছেদ। যে ব্যক্তি মানসিকভাবে সুস্থ তার জন্যেই পৃথিবী আনন্দের এবং সম্ভাবনাময়।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleবইমেলায় অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার এর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন সোমবার
Next articleপ্যারিডোলিয়া: বিভিন্ন কাজে মানুষের মুখের অবয়ব দেখতে পাওয়ার সমস্যা!
ডা. মোহাম্মদ হাসান
রেসিডেন্ট, ফেইজ বি, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ,সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here