আপনার পরিচিত কাউকে কোনও বস্তু বা পদার্থের প্রতি আসক্তিজনিত সমস্যার মোকাবিলা করতে দেখলে বা একজন মাদকাসক্ত বন্ধু থাকলে তা আপনার মোটেই ভালো লাগবে না। এই বিষয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করাও অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হতে পারে।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে মাদকাসক্ত বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে কথা বললে সে বা তারা বিরক্ত হবে কিনা? সে বা তারা কি আপনার কথা আদৌ শুনবে? সে বা তারা কি আপনার এহেন হস্তক্ষেপকে মেনে নেবে?
একজন মানুষ কোনও বস্তু বা পদার্থের প্রতি তার নেশা বা আসক্তি বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার মধ্যে নানারকম প্রেরণাদায়ক অনুভূতি বা বদলের প্রস্তুতি দেখা দেয়। একদিকে এই ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রটি অন্যের পরামর্শের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে পরিবর্তন তখনই সবদিক থেকে বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠে যখন তা মানুষ তার নিজের অন্তরের তাগিদে করে থাকে।
মানুষ অনেক সময়েই আসক্তিজনিত অভ্যাসগুলির প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকে কিন্তু মদ্যপান বা তামাকজাতীয় বস্তুর প্রতি আসক্তি বর্জন করতে সক্ষম হয় না। যদি কোনও ব্যক্তি এক্ষেত্রে তার বন্ধু বা সহকর্মীদের প্রভাবিত করতে পারে তাহলে তার হস্তক্ষেপ ওই বন্ধু বা সহকর্মীর আসক্তি দূর করতে সাহায্যদায়ক হতে পারে, আসক্তি বর্জন করার উদ্যোগ নেওয়াটা তারা উচিত বলে মনে করতে পারে; এমনকী এই পন্থা তাদের সর্বোতভাবেও সহায়তা করতে পারে।
নেশায় বশবর্তী মানুষকে কী কথা বলা ঠিক নয়
প্রায়শই আমরা যখন কাউকে নেশা করতে দেখি তখন তাকে আমরা নানাভাবে দোষারোপ করতে থাকি। বিশেষ করে আমাদের বিভিন্ন বক্তব্যগুলো তাদের সঠিক বার্তা দেয় না। এই বক্তব্যগুলো হল নিম্নরূপ-
- তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না যে তোমার জীবন ও স্বাস্থ্য একেবারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে?
- তোমার কি নিজের পরিবার ও বাচ্চাদের প্রতি কোনও দায়দায়িত্ব নেই?
- এইভাবে চললে তুমি নেশার কবল থেকে বেরোতে পারবে না
- তুমি একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী বা সহকর্মী অথবা অভিভাবক
- তোমার সব সমস্যার মূলে রয়েছে অ্যালকোহল
এইধরনের মন্তব্য শুনে শ্রোতা ভাবে যে তার সমালোচনা করা হচ্ছে এবং এজন্য তারা খুব আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সমালোচকদের কথা তারা ক্রমশ অগ্রাহ্য ও অবহেলা করতে শুরু করে।
এর পরিবর্তে কোন কথা বলা যুক্তিযুক্ত?
খুব হালকাভাবে কথাবার্তা শুরু করা উচিত। এক্ষেত্রে সময়োচিত আচরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা মনে করা ঠিক নয় যে অন্যের কথা শুনে মানুষ মনে মনে নিজেকে আসক্তির শিকার বা শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে ভাবতে শুরু করবে। তাই এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগে তারা বিষয়টা নিয়ে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক কিনা, তা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।
একজন মানুষের আসক্তিজনিত আচার-আচরণের উদাহরণ তুলে ধরে এইধরনের আলোচনা আরম্ভ করা যেতে পারে। যেমন- ”আমি লক্ষ করলাম যে তুমি ইদানীং প্রায়শই কাজ থেকে দেরি করে ফিরছ এবং এজন্য আমি তোমায় নিয়ে খুবই চিন্তিত রয়েছি।” একজন ব্যক্তি যে কোনও একটা বস্তুর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে, তার পক্ষে এই ঘটনার প্রভাব তার কাছের সম্পর্কগুলো বা চারপাশের মানুষজনের উপর কীভাবে পড়ছে, তা বুঝতে পারা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তাই অন্যের চিন্তাভাবনাই এই আলোচনা জারি রাখতে সাহায্য করে।
আসক্তির কুপ্রভাব নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে মানুষের আসক্তিজনিত অভ্যাসের প্রভাব তার শরীর-স্বাস্থ্য, কাজকর্ম এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কীভাবে পড়তে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা অনেক যুক্তিযুক্ত। যেমন- ”আমি লক্ষ করলাম যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তুমি লাগাতার কাজের জায়গায় দেরি করে পৌঁছাচ্ছ। তোমার কি সমস্যা হয়েছে? তোমার কি সাহায্যের প্রয়োজন?”
যদি কেউ অন্য কারোর সঙ্গে নিজেদের অভ্যাস বা কোনও নেশার বস্তু ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করতে ইচ্ছুক হয় তখন কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটিয়ে তাদের কথা মন দিয়ে শোনা দরকার, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি। এমনকী, যদি তাদের কথাবার্তার সঙ্গে কেউ একমত হতে না পারে তাহলেও তারা কী বলতে চাইছে সেকথা শোনা ও বোঝা জরুরি। হতে পারে মানুষ একাকিত্ব বা মানসিক চাপের জন্য কোনও নির্দিষ্ট বস্তুর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। অথবা আসক্তি থেকে তারা দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তা না জানার জন্য তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিচ্ছে।
এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা ভালো, যেমন- ”তুমি কি মনে করছ যে অন্যের সাহায্য পেলে তুমি আসক্তি বর্জন করতে পারবে?”
এক্ষেত্রে তাদের মতামত না জেনেই তাদের সামনে নিশ্চিত সহায়তার আশ্বাস দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু আমি তাদেরকে নিয়ে খুবই চিন্তায় রয়েছি এবং আমি জানি না যে তাদের সঙ্গে আমি এই বিষয়ে ভারসাম্যজনিত আলোচনা করতে পারব কিনা…
আসক্তিপূর্ণ দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ে বন্ধুবান্ধব বা প্রিয়জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। আসক্তি দূর করার বিষয়ে তাদের রাজি করানোও বেশ কষ্টসাধ্য। এই আসক্তির প্রভাব থেকে তাদের বের করা মোটেই সহজসাধ্য নয় এবং প্রভাবের শেষ সীমা যে কোথায় তা নির্ধারণ করাও বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে আত্মসুরক্ষা কেন অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তা বোঝানোও তাদের যথেষ্ঠ কঠিন।
এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা জরুরি যে কী ধরনের সাহায্য সে তার কাছের মানুষকে করতে পারবে। এই আলোচনার মধ্যে নিজের বক্তব্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি, কাউন্সেলর বা হেল্পলাইনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে যে আসক্তিপূর্ণ মানুষটির সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে তার কাছ থেকে আক্রমণাত্মক জবাব শোনার জন্যও প্রস্তুত থাকা জরুরি।
এক্ষেত্রে কেউ যদি সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক না থাকে তাহলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই। যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে সাহায্য দানকারী ব্যক্তির মধ্যে অসহায়তার বোধ, রাগ বা হতাশা জন্মাতে পারে; কিন্তু এক্ষেত্রে যদি কেউ আবেগ বা মানসিক চাপের কারণে দিশাহারা হয়ে যায় তাহলে সে কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সহায়তা নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
মূল লেখক: দিব্যা নাল্লুর, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, পিপ্ল ট্রি মার্গ, ব্যাঙ্গালোর।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন