মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।– কবিগুরুর এই আকুতি বিশ্বজনীন মানবের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা, মানুষের সকল ক্রিয়ার মূল প্রেরণা। তবে আত্মহত্যা কেন ঘটে? এ প্রশ্নের উত্তর গবেষকেরা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা অতীতে করেছেন, এখনো করে চলেছেন।
ধারণা করা হয়, প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে নিজের জীবন শেষ করার পথ বেছে নেন এবং এই সংখ্যা ২০২০ সাল নাগাদ ১৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে। অর্থাৎ প্রতি ৩৫-৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে তৃতীয়, পুরুষদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অষ্টম এবং নারীদের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে ঊনবিংশতম অবস্থানে রয়েছে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আত্মহত্যার চেষ্টা সফল আত্মহননের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি (>২৫/১০০০০০)। গত শতাব্দীর শেষার্ধে সারা পৃথিবীতে, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বের সমান্তরালে বাংলাদেশেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে ক্রমাগত। একটি জরিপ অনুসারে, বিশ্বে আত্মহত্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ ১০ম স্থানে অবস্থান করছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। আত্মহত্যার পরিসংখ্যান ও পদ্ধতিতে জাতিতে-জাতিতে পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। ডব্লিউএইচও প্রকাশিত ২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদনের দেখা যায়, পাশ্চাত্য তথা উন্নত বিশ্বে যেখানে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি, সেখানে আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হওয়ার কারণ আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা, নির্যাতন, ইভটিজিং, যৌতুক, সম্ভ্রমহানি, অবমাননা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি। এ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১২ সালে ১০ হাজার ১৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৫ হাজার ৭৭৩ জন নারী, আর পুরুষ ৪ হাজার ৩৯৪ জন। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে, এদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি।
প্রতিবছরই এই সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া পাশ্চাত্য সমাজে বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার হার মবেশি, কিন্তু এ দেশে বয়সের হিসেবে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মঘাতী হচ্ছে। এরা সাধারণত আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে প্রম গবেষণা করেন ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক এমিল ডুরখেইম। তাঁর মতে, ‘আত্মহত্যা কেবল ব্যক্তির মানসিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই সংঘটিত হয় না, বরং সামাজ কাঠামোর বৈশিষ্ট্যের কারণেও আত্মহত্যা ঘটে।’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের ৯৫ ভাগই কোনো না-কোনো মানসিক রোগে ভোগেন। এছাড়া ব্যক্তির শারীরিক রোগ যেমনদুর্বল শারীরিক অবস্থা, বিশেষত মৃগীরোগ ও দুরারোগ্য শারীরিক ব্যধিসমূহের জন্যেও আত্মহত্যা ঘটে।
আত্মহত্যার সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে এমিল ডুরখেইমের গবেষণার ফলাফলের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক কারণ হচ্ছে- বেকারত্ব, দারিদ্র্য, বিবাহ বিচ্ছেদ বা প্রেমের ব্যর্থতা, সামাজিক বিভাজন, পারিবারিক কলহ, অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি। যারা আত্মহননের পথ বেছে নেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই ব্যক্তিত্বের সমস্যায় ভোগেন বলে জরিপে দেখা যায়। আবেগজনিত মানসিক সমস্যায় যারা ভোগেন তাদের শতকরা ৬ জন আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করেন। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র হতাশা তৈরি হয়। সবকিছুই তারা ভীষণ নেতিবাচকভাবে নেন। নিজের সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ও অন্য মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা পোষণ করেন। তারা ভাবেন, এই পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হবে এবং এটি পরিবর্তনের জন্য শত চেষ্টায়ও কোনো লাভ হবে না। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা- এরকম চিন্তার দ্বারা তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করেন।
সিজফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত রোগী ও মাদকাসক্তদের আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঝুঁকি যথাক্রমে ৫ ও ৬ শতাংশ। আবার কিছু কিছু মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় যেমন তীব্র হতাশা, হঠকারিতা, দ্বৈত চিন্তা, সমস্যার সমাধানে অদক্ষতা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ বহনে অপারগতা ইত্যাদি।
আশ্চর্যজনকভাবে আত্মহত্যার পেছনে আরো একটি সামাজিক কারণ লক্ষ করা যাচ্ছে, যা এই প্রযুক্তির ও অবাধ তথ্য সরবরাহের যুগের ফল আর সেটি হচ্ছে- মিডিয়ার প্রভাব। দেখা গেছে, টেলিভিশন মিডিয়া, চলচ্চিত্র, পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মহত্যার খবর প্রচারের পর আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের আত্মহত্যার ঘটনা আত্মহত্যার পদ্ধতি ও সময়ের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি বা হ্রাসে ঘটনার প্রচারপদ্ধতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে পারিবারিক সমস্যা (৪১.২%), পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া (১১.৮%), বৈবাহিক সমস্যা (১১.৮%), ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া (১১.৮%), বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক (১১.৮%), স্বামীর নির্যাতন (৫.৯%) এবং অর্থকষ্ট (৫.৯%) থেকে রেহাই পেতে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বাংলাদেশে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, আবেগজনিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আত্মহত্যাগুলো ঘটে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সমস্যাটি আসলে পারিবারিক। খবরের কাগজ ঘেটে পাওয়া যায়, যে দুই-তৃতীয়াংশ আত্মহত্যার কারণ হলো দাম্পত্য কলহ এবং তারপরেই পারিবারিক কলহ। এছাড়া যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং, পরীক্ষায় খারাপফলাফল, চাহিদা পূরণ না হওয়া, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, বাল্যবিবাহ, জীবনসঙ্গীর মৃত্যু, সন্তানের মৃত্যু, প্রেমে অসফলতা, শিক্ষকের কটু মন্তব্য, গার্হস্থ্য সন্ত্রাস ও বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি কারণে মানুষ এদেশে আত্মহননের দিকে এগিয়ে যায়।
বৈশ্বিকভাবে যদিও দেখা যায়, শতকরা ৯০ ভাগ আত্মহত্যাকারী এক বা একাধিক মানসিক রোগে ভোগেন, এর মধ্যে বিষণ্ণতাই সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৬০%), কিন্তু আমাদের সমাজে মানসিক অসুখের বিষয়টি বরাবর উপেক্ষিতই থেকে গেছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু অতীতে শিশুদের আত্মহত্যা ছিল খুবই দুর্লভ ঘটনা। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে এই হার বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। এসব আত্মহত্যার বেশিরভাগ ঘটে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, এর কারণগুলো হচ্ছে-মাত্রাতিরিক্ত পড়াশোনা, অভিভাবকদের মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা, শিশুদের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে ব্যর্থতা ইত্যাদি।
অনেকেই ভাবছেন, বর্তমানে নগরায়নের যুগে শিশুরা খুব সহজে একা হয়ে পড়ছে-যার ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া অনেকেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১২ থেকে ২০১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৯৭০টি শিশু আত্মহত্যা করেছে। ২০১৭ সালে ২১৩টি শিশু আত্মহত্যা করে-যে সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ১৪৯। এই আত্মহত্যার মিছিল থামানোর উপায় কী? আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চার ধরনের হস্তক্ষেপের প্রস্তাব করছে-
১. আত্মহত্যার উপায়গুলো সীমিত করা। অর্থাৎ ঔষধ, কীটনাশক ইত্যাদির ক্রয় ও প্রাপ্যতা নিয়মতান্ত্রিক করা ইত্যাদি
২. তরুণ জনগোষ্ঠীকে জীবনে চাপ মোকাবেলা করে টিকে থাকার কৌশল শেখানো
৩. যারা আত্মহত্যার কথা ভাবছেন বা চেষ্টা করেছেন তাদের দ্রুত চিহ্নিত করা এবং তাদের সাথে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে যোগাযোগ রাখা ও ৪. আত্মহত্যা নিয়ে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করতে মিডিয়ার সাথে কাজ করা।
জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এই সমন্বিত প্রতিরোধ কৌশলে কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যেমন- ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও তাদের সাহায্য করা, তাদের মধ্যে সাহায্য চাওয়ার অভ্যাস বাড়ানো, যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা, নিরাপদ সেবা সহযোগিতা করা ও এজন্য আন্তঃসংস্থা যোগাযোগ স্থাপন করা, সংকটাপন্ন প্রতিটি ব্যক্তির প্রয়োজনে যথাযথ সাড়া প্রদান করা, ঘটনা পরবর্তী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ পরিকল্পনা করা, আত্মহত্যার উপায়গুলোর প্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণ করা, চাপ মোকাবেলায় দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু কিছু উদ্যোগ লক্ষণীয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্বিবিদ্যালয়ে ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ ক্লিনিক’, অনলাইন ও টেলিফোননির্ভর সঙ্কটকালীন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘কান পেতে রই’ উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের উদ্যোগ আরো বাড়াতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে মিডিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
যেহেতু আত্মহত্যার একটি বড়ো কারণ হচ্ছে মানসিক রোগ, তাই মানসিক রোগের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মানসিক রোগের প্রতিরোধ, দ্রুত নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসা আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস করতে পারে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও মাদকাসক্তদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সময়োপযোগী ও উপযুক্ত শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। অভিভাবকদের শিশু লালন পালনের ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখাতে হবে। শিশু কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য স্কুলগুলোতে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দেবার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। আত্মহত্যা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য। এ বিষয়ে সচেতন হোন, অকালমৃত্যু প্রতিরোধ করুন।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন