স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশনের রয়েছেন ১৬ হাজার ৮৫৬ জন।
আইসোলেশনে থাকার সময় এমন নানা ধরণের উপসর্গ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ভোগেন অনেকে। জানতে চান যে, এসব উপসর্গ থাকলে কী করা উচিত? আইসোলেশনে কিভাবে থাকা উচিত?
বিশেষজ্ঞদের মতে, নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ বা নেগেটিভ যাই আসুক না কেন করোনা সংক্রমণের এই সময়টাতে কারো মধ্যে কোভিডের মতো উপসর্গ থাকলে তার অবশ্যই আইসোলেশনে থাকা উচিত। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে আইসোলেশনে থাকার বিকল্প নেই।
আইসোলেশনে থাকার সময় মেনে চলবেন যেসব নিয়ম মেনে চলা উচিত সেবিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. লুবনা আফরোজ ইভা এবং আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন এর সাথে কথা বলেছে বিবিসি।
বিবিসি অবলম্বনে আইসোলেশনে থাকার সময়ে করণীয় কিছু পরামর্শ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল :
১. পুরো দিনের একটি রুটিন তৈরি করুন
আইসোলেশনে থাকার সময় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কী কী করবেন তার একটি রুটিন বা তালিকা তৈরি করুন এবং মেনে চলার চেষ্টা করুন। খাওয়া, ঘুম, শরীর চর্চা, বিনোদন মূলক কাজ কখন কত সময় ধরে করবেন তার আলাদা আলাদা তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। যারা ব্যবসা বা চাকরীর সাথে জড়িত তাদের এমনিতেও বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। তারা সেগুলো গুছিয়ে নিতে পারেন। বিভিন্ন ধরণের বিনোদনমূলক কাজ যেমন সিনেমা দেখা, বই পড়ার মতো কাজ গুলো করতে পারেন।আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তির যিনি দেখা-শুনা করেন সেই ব্যক্তির সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এবং মাস্ক ব্যবহার করে যোগাযোগ করা, কথা-বার্তা বলা যেতে পারে।
২. মনোবল শক্ত রাখুন
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেলে অনেকেই ঘাবড়ে যান। মনোবল হারিয়ে ফেলেন। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, মনোবল না হারালে এবং মানসিকভাবে শক্ত থাকাই এসব লক্ষণ থেকে সেরে ওঠার প্রাথমিক শর্ত। যারা কোভিডের উপসর্গে ভুগছে এবং তার হাসপাতালে যেতে হয়নি বরং বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাহলে বুঝতে হবে যে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ তার মধ্যে মৃদু সংক্রমণ হয়েছে। তার সংক্রমণ তীব্র নয়। বাসায় থাকলে যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বর, সারা গায়ে ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা, স্বাদ ও গন্ধ না পাওয়া ইত্যাদি।এসময় মানসিকভাবে শক্ত থাকা বা মন ভাল থাকা মানে হচ্ছে স্ট্রেস হচ্ছে না, স্ট্রেস মানে হচ্ছে এটি শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই স্ট্রেস থেকে মুক্ত থাকা মানে হচ্ছে সুস্থতার দিকে একটা পয়েন্ট এগিয়ে থাকা। আইসোলেশনে থাকার সময় কোভিড সংক্রান্ত খবর না দেখাই ভাল। বরং মন ভাল থাকে এমন সব ইতিবাচক ও বিনোদনধর্মী সংবাদ পড়া ও দেখা উচিত।
৩. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিতে হবে
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ঘুমের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে আইসোলেশনের থাকার সময় একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। সেই সাথে দুপুরে এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়া যেতে পারে। তবে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে অনেকেরই শরীর অনেক সময় বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে তার বেশি ঘুমানোর দরকার হতে পারে। অনেকে অনেক বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছে, বিশেষ করে প্রথম ৬-৭ দিন। সেক্ষেত্রে সে বেশি ঘুমাতে পারে। কোন সমস্যা নেই। তবে আইসোলেশনে যেহেতু একটি ঘরের মধ্যেই বন্দী থাকতে হয় তাই বিশ্রাম নেয়ার জন্য সারাক্ষণ যাতে বিছানাতেই থাকা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রাত এগারোটা থেকে বারটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। অনেকে সারা রাত জেগে মুভি দেখে সারা দিন ঘুমায়। এটা একেবারেই ঠিক না। বিশেষ করে এই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ থাকলে সেটি বেশি ক্ষতিকর। আইসোলেশনে থাকার সময় যাদের মনে হয় যে ঘুমের মধ্যে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে যার কারণে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বলছেন যে, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কারণে অনেক সময় এমনটা মনে হতে পারে। যেকোন এক দিকে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা যাবে না। বার বার ডানে-বামে কাত হয়ে শুতে হবে। মাঝে মাঝে উপুড় হয়েও শুয়ে থাকা ভাল।
৪. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
কোভিডে আক্রান্ত হলে সব ধরণের স্বাভাবিক খাবার বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ সময় পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবল হয়। অনেকে কোভিডের উপসর্গ থাকলে বেশি বেশি গরম পানি, চা, সুপ এবং গরম পানি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রোগী যে খাবার খেয়ে উপশম বোধ করে এমন সব খাবার তাকে খেতে দেয়া যেতে পারে। গলা ব্যথা বা গলায় খুসখুস করলে, ভারী হয়ে থাকলে বা গলায় কিছু জমে আছে এমন অনুভূতি থাকলে গরম পানি খেলে বা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে আরাম বোধ হয়। সেটি করা যেতে পারে। তবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে গরম পানি বা চা খেলেই কোভিড ভাল হয়ে যাবে। এ ধরণের কোন গবেষণা বা প্রমাণ নেই।
৫. শারীরিক ব্যায়াম করুন
আইসোলেশনে থাকার সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে শরীর চর্চা করা যেতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা। তবে এ সময় ভারী কোন ব্যায়াম না করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। শারীরিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শরীরটাকে সচল রাখার জন্য তাকে হালকা ব্যায়াম করতে হবে। তবে যেহেতু এ সময় জ্বর থাকে তাই ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়া ফুসফুসকে সুস্থ ও সবল রাখতে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
৬. রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ
রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। আর সেটি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছালে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন হতে পারে। সেকারণে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বোঝা যায় পালস অক্সিমিটার নামে যন্ত্রের সাহায্যে। সম্ভব হলে এই যন্ত্র সংগ্রহ করে অক্সিজেনের পরিমাণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা যেতে পারে। ৯০ এর উপরে হলে তা খুবই স্বাভাবিক। এর নিচে একবার বা দুই বার নামতে পারে। কিন্তু এটা অব্যাহতভাবে ৯০ এর নিচে থাকলে বুঝতে হবে যে তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে এবং তাকে তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে পালস অক্সিমিটার যন্ত্র ছাড়া বোঝাটা বেশ কঠিন। তবে কিছু উপসর্গ খেয়াল করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া, অনেক বেশি দুর্বল অনুভব করা। তবে জ্বরের কারণেও অনেক সময় দুর্বলতা বাড়ে। তবে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে দুর্বলতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি থাকে মিনিটে ১২-১৮ টা। কিন্তু ওই সময়ে হয়ে যায় ২৮-৩০।
৭. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
যেহেতু করোনাভাইরাসের এখনো কোন ধরণের প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই তাই এর চিকিৎসায় মূলত হয় উপসর্গ ভিত্তিক। যাদের জ্বর রয়েছে তাদেরকে জ্বরের ওষুধ দেয়া যেতে পারে, কাশি থাকলে কাশির ওষুধ। জ্বর বেশি হলে এক সাথে দুটো ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। যাদের অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন ডায়াবেটিক বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, বয়স বেশি তাদের ক্ষেত্রে এ ধরণের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সতর্কতা নিতে হবে। করোনাভাইরাসে জটিলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রক্তে জমাট বেধে যাওয়া। সেক্ষেত্রে সেটি যাতে না হয় তার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে ওষুধ খেতে হবে।
সূত্র: বিবিসি।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন