মানুষ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী জীব। আধুনিক মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স) হলো হোমিনিনা উপজাতির একমাত্র বিদ্যমান সদস্য। শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও ওরাং ওটাংদের মতো মানুষ বানর পরিবারের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের একটি শাখা। তাদের বৈশিষ্ট্য হলো স্থির অবস্থান এবং গতিশক্তি; অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন এবং ভারী সরঞ্জাম ব্যবহারে সক্ষমতা; অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জটিলতর ভাষার ব্যবহার, আকারে বৃহত্তর, জটিল মস্তিষ্ক এবং খুবই উন্নত ও সংঘবদ্ধ প্রাণী।
মানুষের বিস্তার, তাদের বৃহত্তর ও বর্ধমান জনসংখ্যার পরিমাণ পরিবেশের বৃহৎ ক্ষেত্র এবং বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ স্থানীয় প্রজাতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই বিবর্তনীয় সাফল্য ব্যাখ্যা করে যে তাদের বিশেষভাবে সপ্রুতিষ্ঠিত নিওকরটেক্স, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং অস্থায়ী লোবসহ অপেক্ষাকৃত বড়ো মস্তিষ্ক সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে উচ্চ মাত্রার যুক্তি খন্ডন, ভাষার ব্যবহার, সমস্যার সমাধান, সামাজিকতা এবং সংস্কৃতি গড়তে সক্ষম করে তোলে।
মানুষ অন্য কোনো প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। তারাই একমাত্র বিদ্যমান প্রজাতি যারা আগুনের ব্যবহার সম্পর্কে দক্ষ, তারা খাবার রান্না করে খায়, তারাই একমাত্র বিদ্যমান প্রজাতি যারা লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় পরিধান করে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি, শিল্পকলা উদ্ভাবন ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও তারা পারদর্শী।
৬০০ মিলিয়ন বছর ধরে পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের জীবন খাপ খাইয়ে চলছে। প্রাণী এবং উদ্ভিদের বৈচিত্র্যের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি কোণা ভরে গেছে প্রাণের স্পন্দনে। উদ্ভিদ ও প্রাণীরা যেহেতু সবসময়ই টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাই এনভায়রনমেন্টাল শিফট বা পরিবেশের পরিবর্তন এবং মাস এক্সটিংকশন বা ব্যাপক বিলুপ্তি উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য আরো নতুন বিবর্তনগত সুবিধার সৃষ্টি করেছে।
প্রায় ১০,০০০ বছর আগে পর্যন্ত মানুষ শিকারি হিসেবে বসবাস করত। তারা ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর আধিপত্য লাভ করতে শুরু করেছিল। সাধারণত তারা গুহাগুলোর মধ্যে প্রায়ই ‘ব্যান্ড সোসাইটি’ নামে পরিচিত ছোটো ভ্রাম্যমাণ দলে বসবাস করত। কৃষি
উদ্ভাবনের ফলে নব্যপ্রস্তর যুগীয় বিপ্লব ঘটেছিল, খাদ্যের উদ্বৃত্ততা বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষের স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, তাছাড়া পশুপালন এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ধাতু সরঞ্জাম ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল।কৃষিকাজ বাণিজ্য ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করেছিল যা মানুষকে জটিল সমাজের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
বর্তমান দুনিয়াতে পরিবর্তন ছাড়া আর কোনো কিছুই ধ্রুব নয়। তাই অভিযোজন করার ক্ষমতা থাকলে নতুন পরিবেশে অনিশ্চয়তার সময়গুলো ব্যক্তিগত ভালো থাকা না থাকার ওপর খুব কমই প্রভাব ফেলতে পারবে। অভিযোজনক্ষম মানুষেরা সুখী এবং সন্তুষ্ট থাকে কারণ পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তারা তা প্রতিহত করে না। তাদের কিছু চমৎকার গুণ তাদেরকে এসব বৈশিষ্ট্য ধারণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
অভিযোজনক্ষম মানুষেরা নতুন আইডিয়া, পদ্ধতি এবং পরিবেশের প্রতি মানসিকভাবে উন্মুক্ত থাকে। তারা কোনো একটি কাজ সবসময়েই প্রচলিত পদ্ধতিতে অনুসরণ করার চেষ্টা করে না। অনেক সময়েই তারা ভিন্ন ভিন্ন পন্থা খুঁজে বের করে যেখানে তাদেরকে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মখুীন হতে হয়। তারা অনেক প্রশ্ন করে এবং তাদের জানা তথ্যগুলো প্রচলিত পরিস্থিতির সঙ্গে কতটা মানানসই তা ভেবে বের করে। এভাবে বিভিন্ন পন্থার চর্চা তাদেরকে সবসময়েই নতুন কোনো পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখে।
তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা হাইপোথেটিক্যাল আইডিয়াগুলো নিয়ে সবসময়েই চিন্তা করে থাকে। সম্ভাব্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি নিয়ে করা চিন্তাগুলো প্রয়োজনের সময়ে তাদেরকে বাকিদের থেকে এগিয়ে রাখে।
মানুষের অভিযোজনের কিছু চমৎকার উদাহরণ : American Journal of Physical Anthropology জার্নালে দেখাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার এক মানবসমাজ পানিতে থাকা ক্ষতিকর মাত্রার আর্সেনিকের বিরুদ্ধে দৈহিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। চিলির Quebrada Camarones এলাকার মরুভূমিতে গোত্রটি আসে ৭ হাজার বছর আগে, যেখানে পানির অভাবই শুধু নেই, আছে আর্সেনিকের বিষাক্ততাও। এই মরুভূমিতে কিছু নদী বা পুকুুরের মতো পানির উৎস থাকলেও তাতে আছে ক্ষতিকর মাত্রার আর্সেনিক, যা বহু ধরনের অসুখ তৈরি করতে পারে। ১ মাইক্রোগ্রাম প্রতি লিটারে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ বেশি। এই এলাকায় এই বিষাক্ততাবিহীন আর কোনো পানির উৎস নেই, কিন্তু এর মধ্যেও মানুষ হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে। কীভাবে? এখানের মানুষ কি কোনোভাবে অভিযোজন করে নিয়েছেন নিজেদের? কোনো প্রাকৃিতক নির্বাচন চাপ কি প্রভাব ফেলেছে আর্সেনিক-প্রতিরোধী দেহের ব্যবস্থাসহ মানুষের উদ্ভবের?
সাম্প্রতিক পরীক্ষাটি বলছে, হ্যাঁ! চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক খুঁজে পেয়েছেন যে এই মরুভূমি অঞ্চলের মানুষের দেহে AS3MT এর এক ভিন্ন প্রতিরূপ রয়েছে যা আর্সেনিক বিপাককে অতি দক্ষতায় বাড়িয়ে তোলে। এর আগেও ভিয়েতনাম ইত্যাদি এলাকার মানুষের দেহে একইরকম পরিব্যক্তিসহ AS3MT জিনটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ মানুষের দেহ পরিবর্তিত পরিবেশে অভিযোজিত এবং প্রাকৃিতকভাবে নির্বাচিত হয়ে আর্সেনিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা খুঁজে পেয়েছে।
একইরকম বিবর্তনের আরো বহু উদাহরণ উল্লেখ করা চলে। সংস্কৃিত কীভাবে মানুষের জিনেটিক্সকে প্রভাবিত করেছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দুধ খেতে পারার কথা নয়। আপনার পর্বূসূরিদেরও না। মাত্র ৯০০০ বছর আগে থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দুধ খেয়ে হজম করতে পারছে, অসুস্থ না হয়েই। শিশুরা সবসময়েই এটা করতে পারত, কিন্তু যখন থেকে আমরা দুগ্ধখামার শুরু করেছি কেবলমাত্র তখন থেকেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দুধ হজমের ক্ষমতা অর্জন করেছে। এমনটা দেখা গিয়েছে যে যেসব সংস্কৃিতর মানুষ দুগ্ধখামার তৈরি করেছিল এবং নিয়মিত দুধ পান করেছিল তাদের দেহে অন্য এলাকার মানুেষর চেয়ে বেশি মাত্রায় ল্যাকটোজ হজম বা সহ্য করার এবং এ সংক্রান্ত অন্য জিন আছে। ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃিতক আচার-আচরণ কীভাবে মানুষের বিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে তার শুধুমাত্র একটি উদাহরণ হলো এই দুধ পানের ইতিহাস।
সংস্কৃিত দ্বারা জিন প্রভাবিত হওয়ার আরেকটি উদাহরণ হলো, মিষ্টিআলু চাষ এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়ের করোনা সংক্রমণের আগে থেকে পুরো আফ্রিকাজুড়ে মানুষ ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। CDC রিপোর্ট অনুযায়ী (www.cdc.gov/malaria)) ২০১০ সালে প্রায় ২২ কোটি ম্যালেরিয়ার ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং ৬ লক্ষ ৬৬ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই হলো আফ্রিকাতে। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রাকৃিতক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। তাদের লোহিত রক্তকণিকা সাধারণ চাকতির আকৃিত ধারণ না করে কাস্তে বা ঈদের চাঁদের মতো আকৃতি নিয়েছে। এই অদ্ভতু আকৃতির রক্তকণিকার কারণে সিকেল সেল রোগ (কাস্তে কোষ রোগ বলা যায়?) হয় এবং এভাবে কোনো রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ব্যথা এবং অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে।
সাধারণ অবস্থায়, বিবর্তন আমাদেরকে সিকেল সেল রোগ থেকে দূরে রাখে, কারণ রোগটি ক্ষতিকর এবং মানুেষর আয়ু কমিয়ে দেয়। কিন্তু একটি জীববৈজ্ঞানিক উদ্ভট উপায়ে সিকেল সেল জিন ম্যালেরিয়া থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা করে। তাই যেসব স্থানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব বেশি, যেমন আফ্রিকায়, সেখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাস্তেআকৃিতর কোষকে বরঞ্চ পছন্দ করে। জীবনের জুয়া খেলায় সিকেল সেল রোগে ভোগার দাম দিয়েও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধটাই আসলে পছন্দসই উপায়।
এমন জিন-সংস্কৃিতর সহ-বিবর্তনের সবগুলি উদাহরণই ঠিক উপকারী হয়নি। যেমন, পলিনেশিয়ানদের অতিমাত্রায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভুগতে দেখা যায়। এই হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, এমনকি আশেপাশের মনুষ্যগোষ্ঠীর চেয়েও বেশি। একটি গবেষকদল খুঁজে পেয়েছেন যে পলিনেশিয়ানদের মধ্যে PPARGC1A নামক একটি জিন খবু বেশি হারে দেখা যায় এবং সম্ভবত এই হারই কিয়দাংশ টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগের উচ্চহারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কেন তারা এই রোগ দ্বারা এত বেশি আক্রান্ত? গবেষকরা ভাবলেন, নিশ্চয়ই এর সঙ্গে অধিবাসীদের পর্বূসূরিদের সংস্কৃিতআচারের কোনো সম্পর্ক আছে। যখন পলিনেশিয়ানরা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলিতে বসতি গড়ল তখন তাদেরকে দীর্ঘসময় ধরে সমুদ্র পাড়ি দিতে হতো এবং সেসময় দীর্ঘ শীত এবং ক্ষুধার কষ্ট পোহাতে হতো। এই অবস্থাগুলো তাদের পরিপাক এবং পাচঁনকে ‘শক্তিশালী’ করে দিলো এমনভাবে যে খাবার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত চর্বি জমা হতো শরীরে। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্ভবত এর সঙ্গে সম্পর্কিত জিনের প্রকারের হারকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই ধরনের পরিপাকের অভিযোজন হয়ত পূর্বের এই অঞ্চলটির মানুষদের ভ্রমণকে সাহায্য করেছে এবং প্রতিকূলতা কাটাতে সাহায্য করেছে; কিন্তু আধুিনক সংস্কৃতিতে, যেখানে পুষ্টির উপাদান সহজেই পাওয়া যায়, সেখানে এই পরিপাক প্রক্রিয়া আধুনিক পলিনেশিয়ানদেরকে স্থূলকায় করে তোলা এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রকোপ বদ্ধিৃতে সাহায্য করেছে। তাই পলিনেশিয়ান মানুষদের খাদ্যরীতি বা জীবনপদ্ধতি হয়ত তাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্কিত নয়, বরং এমনটা হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষেরা নৌকায় চড়েছিলেন এবং পৃথিবী ভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন বলেই।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা বা অন্য যেকোন ধরনের দায় সর্ম্পূণই লেখকের।