করোনাভাইরাস মহামারি এবং এর জেরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জারি করা লকডাউনের কারণে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
ব্রিটেনের ওয়াটফোর্ড শহরের লিটজি নট এবং অ্যাবার্ডিন শহরের শিক্ষার্থী বার্টি ক্যাম্পবেল ব্যাখ্যা করেছেন যে এই লকডাউন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে।
লিটজি নট, বিষণ্ণতার সাথে বেঁচে থাকা একজন ২২ বছর বয়সী চিত্রকর:
আমার কাছে বিষণ্ণতা অনেকটা এমন, যেন আমার বিড়াল রডনি আমার বুকে ওপর বসে আছে। সে কিছু দিন আমার বুকের ওপর বসে থাকে এবং কোন নড়াচড়া করে না। আমার বিড়াল অনেক ভারী কিন্তু এতোটাও না যে একে আমি বহন করতে পারবো না বা আমি আমার সাধারণ কাজগুলো করতে পারবো না। অনেকটা বাচ্চা কোলে নিয়ে থাকার মতো।
এটার কারণ হল আমি উচ্চমাত্রার বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। ডিপ্রেশনে ভোগা দিনগুলোতে আমি ছোট ছোট বিষয়ে কেঁদে ফেলি এবং মনে হয় জীবনে কোন আশা নেই। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার এই অশান্ত সময়ে আমি অপেক্ষায় ছিলাম কবে এই বিষণ্ণতা আমার ওপর ভর করবে। এবং এই সপ্তাহে এটি শেষ পর্যন্ত হয়েছে।
ডিপ্রেশন হলে মনে হয় সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি থেকে পালানোর কোন সাধ্য আমার নাই। আর এই না পারার অনুভূতি আমাকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন আর হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। এই মহামারীর প্রভাব কতোটা ভারী সেটা এই ডিপ্রেশন আঘাত হানার পর আমি বুঝতে পেরেছি। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আমার জীবন অনেক বদলে গিয়েছে।
অন্য অনেক মানুষের মতো আমিও এতদিন আশেপাশে যা ঘটছে সেই স্রোতের সাথে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এসব নিয়ে আমার মনে কি চলছে সেটা ভাবিনি। আমি চাকরীর জন্য আবেদন করতে পারি না বা আমার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারি না, বা আমার জীবনকে উন্নত করার কথা ভাবতে পারি না এবং এ কারণে মাঝে মাঝে আমার খুব ভয় লাগে।
আমার মনে হয়, “আমি যা কিছুই করি না কেন, তাতে কী লাভ?” আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো হঠাৎ শেষ হয়ে গেল এবং আমি আমার তিনজন প্রিয় বন্ধুর সাথে যে বাসাটায় ভাড়া থাকতাম সেটাও ছেড়ে নিজ বাড়িতে ফিরতে হল।
ওই তিন বন্ধু আমার সাপোর্ট সিস্টেমের মতো ছিল। অর্থাৎ তারা সব সময় আমার পাশে থাকতো। যখন আমরা একে অপরকে বিদায় জানাচ্ছিলাম তখন একমাত্র আমিই কাঁদিনি। আমি শুধু ভেতরে ভেতরে একটা অসাড়তা অনুভব করেছি – এই ভাবলেশহীনতায় মনে হয়েছিল আমি ভাল আছি। আসলে সেটা নকল ভাল থাকা।
অবশ্যই, মনের গভীরে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। তবে মনে হয়েছে আমার মস্তিষ্ক যেন একটা প্রতিরক্ষা মেজাজে চলে গিয়েছে। এখন আমি আমার বাড়িতে ফিরে এসেছি। বাবা-মা, ভাই এবং বোনকে নিয়ে আছি। এই বাড়ি, আমার জন্য একটা অদ্ভুত জায়গা কারণ কয়েক বছর আগে আমার মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যখন সত্যিই খারাপ ছিল এই বাড়ি তখনকার কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমার বিষণ্ণতার সূত্রপাত হয়েছে মানসিক রোগ- পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) থেকে। সারা জীবন হয়তো আমাকে এই বিষণ্ণতা বয়ে বেড়াতে হবে। তবে এটি এমন কিছু যা আমাকে ইতিবাচক শিল্পকর্মের দিকে ঝুঁকতে সাহায্য করেছে। আমি আশা করি যখন এই মহামারী দূর হয়ে যাবে তখন বাড়িতে থাকা নিয়ে আমার নেতিবাচক অনুভূতিগুলো ইতিবাচক অনুভূতিতে রূপ নেবে।
আমরা একজন আরেকজনের পাশে থাকছি। এতদিন ধরে আমরা প্রত্যেককে সমর্থন করে যাচ্ছি। এই সময়গুলো চলে গেলে আমরা রাতের বেলা বোর্ড-গেম খেলে সময় কাটানোর কথাগুলো মনে করবো। বাগানে একসাথে বসে খাওয়ার কথাগুলো অনেক মনে হবে। আমার পরিবার খুবই দারুণ এবং আমার সৌভাগ্য, তাদের সাথে নিরাপদ পরিবেশে থাকতে পারছি।
লকডাউনে থাকাকালীন এই সময়ে আমি প্রচুর ফুল এবং আলোর ছবি আঁকছি কারণ এটি আমাকে মনে করিয়ে দেবে যে বসন্ত এখনও প্রস্ফুটিত এবং পৃথিবী এখনও ঘুরছে। আমি যে জিনিসগুলোকে আগে হেলাফেলা করতাম সেগুলোর ভেতরে এখন আমি সৌন্দর্য খুঁজে পাই।
আমি সত্যিই এখন সূর্যাস্তের অপেক্ষায় রয়েছি। আগে বিশ্ববিদ্যালয় বা কাজের জন্য এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে এই সূর্যাস্তের সৌন্দর্য কখনই খুঁজতাম না। বাড়ির বাইরে ঝিরিঝিরি শান্ত খালটির পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি।
আগে মানুষ তাদের পরিবার নিয়ে এখানে ঘুরতে আসতো। সবার পদচারনায় গমগমে থাকতো এই রাস্তা। আর এই কয়দিন সেটা জনশূন্য। চারপাশের পরিবেশ কী শান্ত। এই লকডাউন আমাকে নিজের বিষয়ে জানতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে প্রচুর সময় দিয়েছে – আমার জীবনের গতি এখন ধীরে বইছে। তবে আমি জানি সবাই ভাগ্যবান না।
মহামারী নিয়ে চিন্তা আমার মনের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে। এখন কেবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই গুরুত্বপূর্ণ এবং ছোট খাট বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার অবস্থা নেই। অবশ্যই আমার মনে হয় যদি আমার কোন হতাশা না থাকতো! তবে এখন আমি আমার এই ডিপ্রেশনকে বরণ করতে শিখছি। যেভাবে আমি আমার পরিচিত মানুষজন বা আমার বিড়ালকে বরণ করে নেই। এবং হতাশার এই সময়টা যখন কেটে যাবে তখন আমার চারপাশের আলো আগের চাইতেও অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে।
বিষণ্ণতায় ভোগা বার্টি ক্যাম্পবেলের সময় কীভাবে কাটছে:
বার্টি ক্যাম্পবেল, একজন ২৩ বছর বয়সী অ্যাবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার নিজেকে নিজের-ক্ষতি করার এবং বিষণ্ণতায় ভোগার ইতিহাস রয়েছে। এখন তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে লকডাউনের সময় কাটাচ্ছেন।
যখন দেখি আমার সব বন্ধুবান্ধব তাদের পরিবারের সাথে থাকতে বাড়ি ফিরে গেছে। আর আমি এখানে আটকে গেছি, তখন খুব কষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে সব এলাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
আমি একদিকে ভাগ্যবান যে আমার প্রেমিক এখানে আমার সাথে থাকছে। এবং আমরা একসাথে বিচ্ছিন্নতার এই সময় কাটাচ্ছি। আমি ১৭ বছর বয়স থেকেই আমার বাবা-মার সাথে থাকি না এবং তাদের কারও সাথেই আর সম্পর্ক নেই। তাই তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার কোন অবস্থা নেই।
লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে আমার বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় এবং তার পর থেকে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কোন অনুপ্রেরণা কাজ করছিল না। কারণ এখন আমাদের আর পরীক্ষা হচ্ছে না। যার মানে, আমি এতদিন কঠোর পরিশ্রম করে যে প্রস্তুতি নিয়েছি, তার সবই অর্থহীন।
আমি যে হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করি সেখান থেকে যখন আমাকে সাময়িক ছুটি দেয়া হয়, আমি প্রচুর গাছপালা কিনেছিলাম যাতে আমার থাকার জায়গাটা অন্তত সবুজে সবুজে শান্তির পরশ দেয়।
বিষণ্ণতা আমার কাঁধের ওপর অনেক ভারী ওজনের মতো অনুভূত হয়। এর অর্থ হল আমি জানি না যে সকালে ওঠার পর আমার হালকা লাগবে বা অসহনীয় দুঃখবোধ ঘিরে ধরবে নাকি প্রতিটি ছোট ছোট জিনিস দেখে মনে হবে আমার পৃথিবীটা যেন ভেঙ্গে পড়ছে।
একটা ঘরে নিজেকে অনেক সময় ধরে আলাদা করে রাখা আমার জন্য কোন নতুন বিষয় নয়। তাই হয়তো অন্য অনেকের চাইতে আমার এই লকডাউনে থাকার প্রস্তুতি কিছুটা ভাল। আমার অবস্থা যখন খুব খারাপ হয়ে যায়, তখন আমি নিজেকে ঘরে লুকিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে কয়েক মাস ধরে নিজেকে আটকে রাখার ঘটনাও আছে।
যারা আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো আমি তাদের ম্যাসেজের জবাব দেওয়া বন্ধ করে দিতাম এবং আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম।
ভাগ্যক্রমে, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় থেকে আমি ভাল কয়েকজন বন্ধু পেয়েছি। যারা আমাকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে যেতো এমন কিছু করার জন্য যেটা আমাকে খুশি করবে বা আমার ডিপ্রেশন ভুলিয়ে রাখবে।
তবে এখন তারা চলে গেছে, আমি আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি এবং আমার হতাশা আমাকে বিশ্বের অন্যান্য মানুষের মতো অনেক বদরাগী করে তুলেছে। আমার খারাপ লাগছে কারণ গতকাল আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করেছি।
আমি তাকে বাইরে গিয়ে তার প্রতিদিনের ব্যায়াম সেরে নিতে বলেছিলাম। পরে আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি বার্তা পাঠাই। আমি এই একঘেয়েমি জীবন নিয়ে রীতিমত সংগ্রাম করছি এবং নিজেকে চাঙ্গা রাখার জন্য উৎপাদনশীল উপায়গুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। যারা ফেসবুকে আজেবাজে জিনিষপত্র ছড়াচ্ছে বা করোনাভাইরাস নিয়ে মিথ্যা তথ্য পোস্ট করছে, আমি তাদের সাথে রীতিমত তর্ক শুরু করি।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে স্ক্রোল করে সময় কাটানো থেকে আমাকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। কারণ এটি আমাকে খুব ক্লান্ত করে ফেলে এবং আমি সম্পূর্ণ অর্থহীন তর্ক করে সময় নষ্ট করছি।
এই লকডাউন শুরু হওয়ার পর আমার প্রেমিক এবং আমি ঘুম থেকে উঠে নেটফ্লিক্স দেখতাম এবং ভিডিও গেম খেলতাম তবে এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে সে স্প্যানিশ ভাষা শিখবে এবং আমি ইতালিয়ান ভাষা শিখব।
যেটা আমরা অনেকদিন ধরেই করবো করবো বলে ভাবছিলাম কিন্তু করা হচ্ছিল না। আমি প্রায় ছয় মাস ধরে আমার গিটারটি ছুঁয়েও দেখিনি। আমার মনে হল, এটাই হয়তো আমরা ফেলে রাখা কাজগুলোকে সেরে নেয়ার উপযুক্ত সময়। আমি খেয়াল করেছি যে আমি এ কয়দিন খুব বেশি মদপান করছি এবং এই সপ্তাহে আমি এটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। যখন মনের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ থাকে মানুষ তখন সহজেই বিভিন্ন বদ অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে।
“তবে যাদের অবস্থা আমার মতো এবং যারা আমার এই লেখাটি পড়ছেন তাদেরকে আমি বলব – প্রতিদিন নিজের যত্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন অন্তত একটি কাজ করার চেষ্টা করুন। -এটি আপনার জীবন বদলে দেবে।”
আমার জন্য, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাইরের দুনিয়ার বন্ধুদের সাথে কথা বলা। সেটা অনলাইনে হোক, টেক্সটের মাধ্যমে হোক বা ফোনে কল করার মাধ্যমে হোক। আমি জানি যে প্রতিদিন বাইরে গিয়ে ব্যায়াম করলে লাভ হবে। তবে সেটা করার মতো অনুপ্রেরণা এখন আমার নেই। আমি সম্প্রতি যেদিন বাজার করতে বের হই তখনই বুঝতে পারি যে বাইরের গন্ধটাই যেন আমি ভুলে যাচ্ছি। আমি কিছু ঘাস মাড়িয়ে ভাবলাম, “আহা, ঘাস সত্যিই কী সুন্দর”।
সূত্র: বিবিসি