করোনাভাইরাস মোকাবেলায় একেক দেশ একেকভাবে সাড়া দিয়েছে কোনো কোনো দেশ, রাজ্য ও শহর অন্যদের চেয়ে ভালো ফল দেখিয়েছে। ইম্পেরিয়েল কলেজ লন্ডন এবং অন্যান্য গবেষণা দেখিয়েছে, দেশগুলো নিজেদের সীমানার ভেতর কতটা ভিন্ন ও নাটকীয়ভাবে এটি সামাল দিয়েছে। পাশাপাশি কোন উদ্যোগটি সবচেয়ে কার্যকর ছিল, তাও দেখিয়েছে তারা।
জার্মানি বনাম সুইডেনের উদাহরণটি নেয়া যাক। দুটি দেশেই প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছিল জানুয়ারির শেষ দিকে চারদিনের ব্যবধানে। দুটি দেশই ইউরোপের ধনী দেশগুলোর অন্যতম, যাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও বেশ ভালো। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় মাথাপিছু হিসাবে সুইডেনে মৃত্যুহার জার্মানির তিন গুণ। এমনকি জার্মানি সবকিছু খুলে দেয়ার পরিকল্পনাও করছে।
মূলত দ্রুত ও বিস্তৃত পদক্ষেপের কারণে এই বিপরীতমুখী ফলাফল দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন ইনফেকশাস ডিজিজ এপিডেমিওলজস্ট নিকোলাস গ্রাসলে।
এই প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে জার্মানি দ্রুতই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল। পরীক্ষা, কন্টাক্ট ট্র্যাকিং এবং সীমান্তে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এক্ষেত্রে সুইডেনের চেয়ে কয়েকদিন এগিয়ে ছিল তারা। পাশাপাশি স্কুল বন্ধ করা, পাবলিক ইভেন্ট নিষিদ্ধ করা এবং ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়ার মধ্য দিয়ে তারা কমিয়ে আনতে পেরেছিল সংক্রমণ। এমনকি এ সময়ে এসেও সুইডেন পুরোপুরি লকডাউনে যেতে পারেনি।
পুরোপুরি লকডাউনের পরিবর্তে সুইডেন সামাজিকভাবে কিছু বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। দেশটিতে গতকাল সকাল পর্যন্ত ২ হাজার ৬৫৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছে। যা কিনা মাথাপিছু হিসেবে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হওয়ার হার ২.৩ থেকে ১.১-এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে জার্মানিতে গতকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৩৬। যা কিনা দেশটির সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় সামান্য। শুরুর দিকেই সামাজিক বিধিনিষেধ ও বিস্তৃত টেস্টের কারণে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছে তারা। দেশটিতে একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হওয়ার হার জানুয়ারির ২৮ তারিখে প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর ৪.২ থেকে নেমে এসেছে ০.৭-এ। এ প্রতিবেদনের পরের অংশে কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় দেশগুলো কীভাবে সাড়া দিয়েছে তার পর্যালোচনা তুলে ধরেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কি কাজ করেছে?
গবেষণা বলছে, নববর্ষের প্রাক্কালে চীন আন্তর্জাতিক সতর্কবার্তা পাঠানোর এক মাস আগেই এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল। আর আমরা জানি যে কভিড-১৯ কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়ার আগেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং চীনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আলোচনা করার লক্ষ্যে ২২ জানুয়ারি বৈঠকে বসে। তখন এশিয়ার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮২টি এবং কোনো মৃত্যুর খবরও ছিল না। কিন্তু তখনই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
দ্রুত সাড়া
নরওয়ের প্রথম পদক্ষেপই ছিল সামাজিক বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে লকডাউনে যাওয়া। কভিড-১৯ দেশটিতে ১৯৩ জনের প্রাণ নিয়েছে। কিন্তু জরুরি পদক্ষেপের কারণে আরো ১৪৪-২৫৪ জনের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। অস্ট্রিয়াও একইভাবে শুরু থেকে দ্রুত সামাজিক বিধিনিষেধ প্রয়োগ করেছে।
অবশ্য এর পরও বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের মাত্রা কমে আসেনি। ভাইরাসের উত্পত্তিস্থল উহানকে লকডাউন করা হয় ২৩ জানুয়ারি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১ থেকে ২৪ জানুয়ারির মাঝে ১১.৫ মিলিয়ন মানুষ উহান ছেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেশির ভাগ প্রবাসীর জন্য দ্বার উন্মুক্ত রাখায় এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। অনেক দেশেই শুরুর দিকের আক্রান্ত লোক ছিলেন বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীরা।
উচ্চমাত্রায় পরীক্ষা
একটি দেশে কভিড-১৯ মোকাবেলায় রাষ্ট্রগুলো কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা হিসাব করা হয় মাথাপিছু কতজনকে টেস্ট করা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে। দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যন্ডের মতো দেশগুলো যারা সংক্রমণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, তারা শুরু থেকে মাথাপিছু উচ্চমাত্রায় পরীক্ষা চালিয়েছে।
ধীর প্রতিক্রিয়া
ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেনের মতো দেশগুলো শুরু থেকেই কভিড-১৯ মোকাবেলায় ঠিকঠাক সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর নেয়া পদক্ষেপও ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার বিষয়ে দেখা গেছে অবহেলা। যদিও পরীক্ষা কোনো নিরাময় নয়। কারণ রোগের কোনো উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগেই অনেক লোক সংক্রমিত হয়ে পড়ে। যে কারণে কন্টাক্ট ট্র্যাকিং শনাক্ত করার জন্য অনেকগুলো নতুন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে। কোথাও লোক নিয়োগ দিয়ে আবার কোথাও স্মার্টফোন অ্যাপ তৈরি করে এটা করা হচ্ছে। উচ্চমাত্রায় পরীক্ষা ও কন্টাক্ট ট্র্যাকিংয়ের কাজ একসঙ্গে করে অনেক দেশ এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে।
নিয়ম মানা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামাজিক বিধিনিষেধের যে নিয়মকানুন তা ঠিকঠাকভাবে মেনে চলা। মানুষ যদি সামাজিক বিধিনিষেধগুলো মেনে না চলে তবে এসবের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। গবেষণা বলছে, ভাইরাসবাহী রোগগুলো মূলত বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্নভাবে ছড়ায় সামাজিক যোগাযোগের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে। অনেক দেশে সংক্রমণের মাত্রা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়ার পর। মূলত মানুষের আচরণগত পরিবর্তনই বদলে দিতে পারে সংক্রমণের হার। সেটি হতে হবে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সকল পর্যায়ে।