আধুনিক সমাজে ই-মেইল, ফেসবুক কিংবা মেসেঞ্জার ছাড়া আমাদের জীবন প্রায় অচল বলা চলে। বর্তমান সময়ে আমাদের জীবন প্রযুক্তিগত ডিভাইস বেষ্টিত। এমনকি আমরা শিশুদের সামলানোর জন্য তাদের হাতেও তুলে দিচ্ছি শুধু মোবাইল নয়, স্মার্টফোন-ট্যাব বা ল্যাপটপ। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার এই জগতে প্রবেশ করে তার নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। ফলে তথ্য প্রযুক্তির সুফলের চেয়ে কুফলটাই গ্রাস করছে তাদের।
সাম্প্রতিককালে শিশুর মাঝে বিভিন্ন ডিজিটাল স্মার্ট ডিভাইসের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির কারণে অভিভাবকগণ সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এইক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কারণ এইসব ডিভাইস অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিশুর দক্ষতার বিকাশ, কথা বলতে শেখা এবং অন্যান্যদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। শিশুদের এই ডিভাইস ভাইরাসের কালো ছায়া থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের উচিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া। ব্যবস্থাগুলো হতে পারে নিম্নরূপ:
- পরিবারের সদস্যদের ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত সময় কাটানোর অভ্যাস পরিহার করতে হবে। কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাই অন্যদের দেখে শিশুরাও ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
- প্রতিদিন খাবার টেবিলে কিংবা পারিবারিক আলোচনার সময় মোবাইল জাতীয় ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। শিশুদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
- শিশুর জন্য আনন্দঘন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে তারা বেশি সময় স্ক্রিনে ব্যয় না করে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে যে সব শিশু স্ক্রিনের সামনে বেশি সময় পার করে তাদের পড়াশোনার মনোযোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্থূলতা বা ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- শিশু যখন বুঝতে শেখে তখন থেকেই তাকে সমবয়সীদের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ অনেকের মাঝে থেকে শিশু মেধা খাটিয়ে নতুন নতুন জিনিস শেখে ও জানে।
- শিশুরা ডিভাইসে কী দেখছে, কী করছে সেদিকে অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে। তাদের ডিভাইস ব্যবহারে সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। তাদের আগ্রহের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেগুলো নিয়ে তার সাথে আলাপ করতে হবে। যাতে তার মধ্যে লুকোনোর প্রবণতা তৈরি না হয়। আর তারা এমন বোধ না করে যে, অভিভাবক তাদের ওপর নজরদারি করছে। উপরন্তু অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের আস্থা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে।
- শিশুদের কোনোভাবেই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে দেয়া উচিত নয়। কারণ এ সময় তাদের নিজেদের মেধা খাটিয়ে নতুন নতুন জিনিস শেখার ও জানার বয়স। বরং তাদের হাতে তুলে দেয়া যায় রঙিন রঙিন বই। বাড়ির ছোটো ছোটো কাজে তাদেরকে সাথে নেয়া যায়। এতে তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাববে, সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হবে এবং ডিভাইস-নির্ভর হয়ে উঠবে না।
- শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, তাদের সাথে সময় কাটানো বা তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে।
- শিশুদেরকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এতে তার মনোযোগ, ভালো লাগা এবং আনন্দ ডিভাইস কিংবা স্ক্রিনে কেন্দ্রীভূত না থেকে বিস্তৃত হবে। সবসময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ না হলেও বাড়ির উঠোনে, ছাদে বা বারান্দায় শিশুদের সাথে নিয়ে গাছ লাগানো, প্রতিদিন গাছে পানি দেয়ার মতো কাজগুলো করা যায়।
- অভিভাবকদেরকেও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। যাতে তারা প্রযুক্তির ভালো-খারাপ উভয় বিষয় নিয়েই সন্তানদের সাথে কথা বলতে পারেন। একতরফাভাবে প্রযুক্তি বিদ্বেষী কথা বা মনোভাব শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই কৌশলী হতে হবে।
শিশুকে বাস্তব ও ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করে দেয়ার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই। মনে রাখতে হবে, কোনো শিশুই ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে জন্ম নেয় না। সেটা তার ভেতর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। আর সেটা প্রতিহত করতে অভিভাবকই। প্রয়োজন সঠিক সময়ে সচেতন হওয়া। বড়ো সামাজিক অবক্ষয় নেমে আসার আগে অভিভাবকদের সচেতন হবার সময় এখনই।
সূত্র: মনের খবর, মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।