আজকাল আমরা অনেককেই বলতে শুনি বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া করো না, কিংবা অন্তত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ কমিয়ে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখো বা সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো। কিন্তু আমরা এটা জানি না যে, কেন আর কিভাবেইবা বাবা-মায়ের আচরণে শিশুমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
আমরা কি কখনো লক্ষ্য করেছি আমাদের সন্তান আসলে আমাদেরই প্রতিবিম্ব? আমরা যা করি, যে কথা বলি, যেভাবে বলি, যেভাবে খাই বা ঘুমাই মোটকথা আমরা যে আচরণ করি আমাদের সন্তানও ঠিক তাই করে। অর্থাৎ আমাদের প্রায় হুবহু নকল বা কপি করার চেষ্টা করে। এটা যেমন হতে পারে আমাদের দেখে তেমনি হতে পারে শারীরিক ও জিনগত কারণে। আর এ কারণেই একটি সন্তান বাবা-মা দুজনের প্রতিই আগ্রহ বা টান বোধ করে। যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় বলি ‘রক্তের টান’।
এছাড়াও সামাজিক প্রক্রিয়ায় প্রায় প্রতিটি বাবা-মা সন্তানের পাশে সুখে দুঃখে একসঙ্গে থাকে এবং একটা নিবিড় বন্ধন প্রতিটি স্বাভাবিক পরিবারে বিরাজ করে। তাই একটি শিশুও চায় অন্য পরিবারের মতো তার বাবা-মাও তার সঙ্গে এবং দুজন দুজনের সঙ্গে ভালো থাকুক।
যখন এর ব্যতিক্রম হয়, তখন একটি সন্তান বুঝতে পারে তার বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক বা ভালো নেই, শিশুটির কোমল মন তখন অনেক বেশি ভীত হয়ে পড়ে এবং সে একটি অজানা আশঙ্কায় ভুগতে থাকে। এই বুঝি সে দুজনকে হারিয়ে ফেলবে বা তার এ নিরাপদ আশ্রয় আর হয়তো থাকবে না। তার মনে হয়ত প্রশ্ন জাগে, কেন তার বাবা-মায়ের সম্পর্ক অন্যদের মতো নয়?
আর তখনই সে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিবারের অবস্থার জন্য কখনও লজ্জিত, কখনও ছোট অনুভব করে। এভাবেই তার মধ্যে গড়ে ওঠে নিরাপত্তাহীনতা, হীনমন্যতা, ভয়, রাগ কিংবা হতাশা।
বাস্তবিক অর্থে যারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সুখী তাদের সন্তানও সুখী হয়।
কারণ স্বামী-স্ত্রী যখন নিজেদের সম্পর্কে সুখী হয় না, তখন তার নেতিবাচক প্রভাব শিশু লালন পালনেও পড়ে। কখনও কখনও তারা সন্তানের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে। অনেক সময়তো এমনো দেখা যায় যে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে অপছন্দ করার কারণে তারা সন্তানকে নিজের দলে টানতে চান। কখনবা সন্তানকে অন্য জনের কথা না শোনারও প্ররোচনা দেন। সেই সঙ্গে সন্তানের সামনেই একে অপরের তীব্র নেতিবাচক সমালোচনা করেন। যার অনেক সময় শিশুটির দুজনের সম্পর্কেই নেতিবাচক ধারণা গড়ে ওঠে। সে হয়তো কাউকেই শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারে না।
সে বুঝতে পারে না কোনটি তার জন্য ঠিক আর কোনটি ভুল। অনেক সময় সন্তানকে নিজের দলে টানতে বাবা-মা তাদের মাত্রারিক্ত সুযোগ দিয়ে ফেলে, ফলে সন্তান যার কাছ থেকে সুযোগ বেশি পায় তাকে মানে আর যখন সুযোগের অভাব ঘটে তখন কাউকেই মান্য করে না এবং তখন যা মন চায় তাই করে। এছাড়াও ছোট বেলায় ভুল আচরণ দেখে শিশুটি বড় হলেও সেই ভুল আচরণের ভেতরই থেকে যেতে পারে।
ধরা যাক স্বামী তাঁর স্ত্রীর উপর ভীষণ রাগারাগি করেন এবং এটি করে তিনি ভালো থাকেন এবং সব সুবিধাই বজায় থাকে। এই কাজটি দেখে সন্তান এই একই ধরনের আচরণ শিখতে পারে। কারণ সে দেখে তার বাবার খারাপ আচরণটি পুরস্কৃত হচ্ছে। যদিও সে ছোটবেলা থেকে দেখেছে তার বাবা ভুল করছে মায়ের ওপর এবং সে তার মাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। কিন্তু তার ছোটবেলার পর্যবেক্ষণ থেকে বড় হয়ে সেও মায়ের ওপর একই আরচণের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। পরবর্তীতে সন্তানটি তার সঙ্গীর সঙ্গেও একই আচরণ করে। অথচ এসব আচরণের জন্য সে সবসময় তার বাবাকে অপছন্দ করেছে।
এভাবে শিশুদের সুপ্তভাবে অনেক ভুল শিক্ষণ হয়ে থাকে যা তার নিজের জীবনে অন্যের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সমস্যা সৃষ্টি করে।
শিশুদের নিবিড় সম্পর্কের মূল ধারণা তৈরি হয় প্রাথমিক ভাবে বাবা-মার মধ্যে সম্পর্কের ধরন দেখে। সাধারণত বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক যে রকম হয় শিশুরা পরবর্তীতে বড় হয়ে তার জীবন সঙ্গীর সঙ্গে ঠিক সে রকম সম্পর্কই গড়ে তোলে। যদি মা-বাবার সম্পর্কের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ও যান্ত্রিক সম্পর্ক থাকে তাহলে অনেক শিশু সেটাকেই স্বাভাবিক সম্পর্ক মনে করে। পরবর্তীতে সে তার স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গেও একটি যান্ত্রিক অথবা বৈষয়িক সম্পর্ক ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। আবার কোনো শিশু যদি ছোট বেলা থেকেই বুঝতে পারে তাদের বাবা-মায়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়, তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে বিয়ের পর তাদের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে না। এ কারণে অনেকে বিয়েই করতে চায় না। আবার কেউ কেউ একটি সুন্দর সম্পর্কের প্রতি আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে এবং অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ হয়ে তার আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়, যাতে তাদের সম্পর্ক তার বাবা-মায়ের মতো না হয়। আর বিষয়টিতে তারা খুবই সংবেদনশীল হয়। ফলে সঙ্গীর সামান্য ভুলও তাদের কাছে অনেক বড় মনে হয়। মনে হয় তার সম্পর্কও খারাপ হয়ে যাবে।
আসলে এসব ব্যক্তির মধ্যে শিশু বয়স থেকে ভালো সম্পর্কের ঘাটতি থেকে ভালো সম্পর্কের প্রতি এক ধরনের চরম আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়। কিন্তু যেহেতু শিশুটি বড় হয়েছে বাবা-মায়ের নেতিবাচ সম্পর্ক দেখে এবং তাতে তারাও বঞ্চিত অনুভব করেছে তাই ভালো সম্পর্কের স্থায়িত্বের প্রতি তাদের অবিশ্বাসও কাজ করে। তারা ভাবে তাদের পক্ষে একটা ভালো সম্পর্কের মধ্যে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়।
এভাবে বাবা-মার খারাপ সম্পর্ক তাঁদের সন্তানদের সব সময় নিরাপত্তাহীনতা, হীনমন্যতা, আশাহত ব্যক্তিতে পরিণত করে। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাঁদের সম্পর্কের টানাপড়েনে নিজেরা হতাশায় ভোগে এবং সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন।
অধিকাংশ সময় তাদের প্রতি আদর, যত্ন ও ভালোবাসা প্রকাশের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। ফলে সন্তানটির ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশ কখনও কখনও ব্যহত হয়ে সন্তানটি নিজেকে অবহেলিত, অবমূল্যায়িত কিংবা ভালোবাসাহীন মনে করে। সারা জীবন সে একটি শূন্যতা নিয়ে বসবাস করে। কোনো সম্পর্কই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। তার নিজেকে প্রায়ই অসহায় ও একা লাগে।
তাই দম্পতি এবং বাবা-মায়ের প্রতি অনুরোধ থাকবে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বিয়ে টিকিয়ে রাখাই যথেষ্ট নয়, বরং আপনাদের নিজেদের সম্পর্ক সুন্দর করার চেষ্টাই আপনার সন্তানকে একটি সুখী আর সুন্দর স্বাভাবিক জীবন দিতে পারে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।