ওথেলো সিনড্রোমঃ ভালোবাসাজনিত সন্দেহপরায়ণতা

0
40
যে অভ্যাস রপ্ত করলে বাড়বে স্মৃতিশক্তি

ওথেলো সিনড্রোমঃ
ঈর্ষা মানুষের খুব স্বাভাবিক একটি অনুভূতির নাম। ঈর্ষার বদৌলতেই মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে যেমন, একইভাবে ঈর্ষার জন্য মানুষ নিজের এবং তার আশপাশের মানুষের জীবনকেও বিষিয়ে তুলতে পারে।
ঈর্ষার কারণে মানুষের মনে জাগে সন্দেহ, আর সেই সন্দেহ যদি হয় ভালোবাসার মানুষটির উপর, তাহলে যে সে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, সে তো বলাই বাহুল্য। তবুও সাধারণ মানুষ হিসেবে একজনের মনে সন্দেহ জাগতেই পারে। কিন্তু অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন সন্দেহ থেকে সৃষ্ট তিক্ততা সম্পর্কটি ধ্বংস করে ফেলতে পারে অনায়াসে।
অনেক সময় প্রিয় মানুষটির উপর এহেন অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন সন্দেহ এতোটাই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে যে, তা মানুষকে এমন সব কাজ করতে প্ররোচিত করে, যা তার নিজের এবং আশপাশের মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনে।

অতিরিক্ত সন্দেহপরায়ণতার এই মানসিক ব্যাধির নাম প্যাথোলজিকাল জেলাসি (Pathological Jealousy), যার অর্থ হলো বিকারগ্রস্ত ঈর্ষা বা সন্দেহপরায়ণতা  (Morbid Jealousy)। এর আরেক নাম ওথেলো সিনড্রোম (Othello Syndrome)।
কী এই ওথেলো সিনড্রোম?
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অন্যতম ট্র্যাজেডি ‘ওথেলো’ এর মূল চরিত্র ওথেলোর নামানুসারে এ রোগের নামকরণ করা হয়েছে। শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত এ ট্র্যাজেডিতে ওথেলো তার সৎ এবং সুন্দরী স্ত্রী ডেসডেমনার পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার সন্দেহে তাকে হত্যা করে। পরে জানা যায়, তার সন্দেহ অমূলক ছিল। অযৌক্তিক সন্দেহপরায়ণতার এই মানসিক ব্যাধিকে এজন্যই দেওয়া হয়েছে ওথেলোর নাম।
ব্রিটিশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জন টড ১৯৫০ সালে ওথেলো সিনড্রোমের বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেন।
ওথেলো সিনড্রোম তথা প্যাথলজিকাল জেলাসি বলতে কোনোরকম যুক্তি ছাড়াই সঙ্গীর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সন্দেহপরায়ণতা এবং অবিশ্বাস এবং তা থেকে সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যাকে বোঝায়। এতে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানুষ অনলাইনে উত্যক্ত করা, আড়িপাতা থেকে শুরু করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, এমনকি খুন পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় যে, ব্যক্তিটির সন্দেহ ভিত্তিহীন ছিল। এ মানসিক ব্যাধিতে মানুষ তার যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে, ঈর্ষা ও সন্দেহের দহনে সে অকল্পনীয় কাজ করতে বাধ্য হয়। নিজের প্রিয় মানুষটির ক্ষতি করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। অনেক সময় সে নিজের সন্তানদেরও ক্ষতি করে বসতে পারে।
কারা আক্রান্ত হয়?
১৯৯৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওথেলো সিনড্রোমের ২০টি কেসের মধ্যে আক্রান্ত ১৯ জনই পুরুষ। নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে এ ব্যাধি দেখা যায় বেশি। ওথেলো সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শতকরা ৮০ ভাগই বিবাহিত। এ ব্যাধির কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। ২৮ বছরের তরুণ থেকে শুরু করে  থেকে ৭৭ বছর বয়সী বৃদ্ধের মাঝেও এ রোগের লক্ষণ দেখা গিয়েছে। সঙ্গীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রেও নারীর চেয়ে পুরুষের হার বেশি। হত্যা করার ক্ষেত্রেও পুরুষদের সংখ্যা বেশি। অনেক সময় দেখা যায় যে, আক্রান্ত ব্যক্তি সঙ্গীকে হত্যার পর আত্মহত্যা করে থাকে।
কেন দেখা দেয় এই সিনড্রোম?

ওথেলো সিনড্রোমকে এক ধরনের ওসিডি (OCD) তথা Obsessive Compulsive Disorder বলা চলে। এক্ষেত্রে সঙ্গীর উপর ব্যক্তির মালিকানা আছে বলে সে মনে করে এবং এ মালিকানা সম্পর্ক রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিশ্বাস করে। মালিকানাকে খর্ব করতে পারে এমন কিছুই সে মেনে নিতে পারে না। সঙ্গীর উপর তার মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ থেকে সন্দেহ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তা যতই অযৌক্তিক হোক না কেন। তার সন্দেহকে ভুল প্রমাণ করলেও তা সে মেনে নেয় না বরং তার সন্দেহটিই ঠিক, এমন বিশ্বাসে অটল থাকে।
ওথেলো সিনড্রোমের সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এর সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তির ভালোবাসা ঘাটতির বোধ, নিরাপত্তাহীনতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অবলম্বন হারানোর ভীতি এবং তার জন্য সঙ্গীকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা।
অন্য আরো কিছু বিষয়ের সাথে ওথেলো সিনড্রোমকে সম্পর্কিত করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে মাদকাসক্তি, ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়া, ব্রেইন ডিজঅর্ডার, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ও নানা মানসিক ব্যাধি। ওথেলো সিনড্রোমের পেছনে এই বিষয়গুলো চলক হিসেবে কাজ করে থাকে। অনেকে আবার ওথেলো সিনড্রোমকে এসব রোগের লক্ষণও মনে করে থাকেন।
কী কী লক্ষণ দেখা যায়?
ওথেলো সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। এগুলো হলো,
। ব্যক্তি তার সঙ্গী অপর আরেকজনকে তার সময় এবং মনোযোগ দিচ্ছে- এ অভিযোগ তোলা।
২। সঙ্গীর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা।
৩। সঙ্গী ফোনে কাদের সাথে কথা বলছে তা নিয়ে সর্বক্ষণ জেরা করা।
৪। সঙ্গীকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (যেমন- ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি) ব্যবহার করতে না দেওয়া। অথবা ব্যবহার করতে দিলেও তার পাসওয়ার্ড নিজের কাছে রাখা এবং প্রায়ই তাতে ঢুঁ মারা।
৫। সঙ্গীর ফোনে আড়িপাতা।
৬। অনুমতি ছাড়া সঙ্গীর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে (ব্যাগ, কাগজপত্র ইত্যাদি) হাত দেওয়া।
৭। সঙ্গী কোথায় গেছে, কার সাথে গেছে, কেন গেছে তা নিয়ে সবসময় জেরা করা।
৮। সঙ্গীর চলাফেরার পরিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলা।
৯। সঙ্গীকে অন্যের সাথে মিশতে বাধা দেওয়া।
১০। সঙ্গীকে তার পছন্দের বা শখের কাজ করতে বাধা দেওয়া। এ রোগে আক্রান্ত এক নারী তার স্বামীকে রোমান্টিক গান শুনতে এবং চলচ্চিত্র দেখতে বাধা দিতেন, কেননা তার সন্দেহ ছিল, তার স্বামী সেই গানের গায়িকার বা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীর প্রেমে পড়ে যেতে পারেন। আরেক ক্ষেত্রে দেখা গেল, আক্রান্ত এক পুরুষ তার স্ত্রীকে বই পড়তে বাধা দিত, পাছে যদি তার স্ত্রী বইয়ের কোনো চরিত্রের প্রেমে পড়ে যায়!
১১। সঙ্গীকে তার কর্মক্ষেত্রে বাধা দেওয়া।
১২। সমাজে মেশার ক্ষেত্রে সঙ্গীর উপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ, শর্তাবলি আরোপ করা।
১৩। যুক্তি ছাড়াই সঙ্গীর উপর পরকীয়ার অভিযোগ তোলা।
১৪। সন্দেহের দরুন সঙ্গীর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অথবা যার সাথে তাকে জড়িয়ে সন্দেহ করা হয়, তাকে আক্রমণ করা।
১৫। নির্যাতন থেকে বাঁচার চেষ্টা করলে সঙ্গীর উপর পরকীয়ার অভিযোগ তোলা। নির্যাতনের কারণে দাম্পত্য জীবনে যৌনমিলন বাধাগ্রস্ত হলে তার জন্য সঙ্গীর পরকীয়াকে দায়ী করা।
১৬। সন্দেহপরায়ণতার অভিযোগ অস্বীকার করা।
১৭। সন্দেহ ভুল প্রমাণ হলেও সেই সন্দেহকে আঁকড়ে রাখা, কোনো যুক্তি না মানা।
১৮। বিশ্বাসের চরম অভাব তৈরি হওয়া।
তাহলে উপায়?
রোগের চিকিৎসার পূর্বে রোগের মূল্যায়ন করা জরুরি। ওথেলো সিনড্রোম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হয় তা হলো,
১। রোগীর আর কোনো মানসিক ব্যাধি আছে কিনা।
২। রোগীর সহিংসতার বা আত্মঘাতী হবার রেকর্ড আছে কিনা।
৩। সঙ্গীর সাথে তার সম্পর্কের ধরন।
৪। রোগীর পরিবার এবং তার বেড়ে ওঠার ইতিহাস।
৫। রোগীর বয়ান।
৬। সঙ্গীর বয়ান।
৭। সন্তান থাকলে তাদের জন্য বিষয়টি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা নিরুপণ।
এ রোগের চিকিৎসা দুটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রথমত, যে মানসিক রোগে আক্রান্ত, তার জন্য প্রয়োজনীয় পথ্য সেবন। এরপর আসবে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং।
এ কাউন্সেলিং রোগী এবং সঙ্গী উভয়কেই নিতে হয়। অনেক সময় রোগী এত বেশি সহিংস হয়ে যায় যে, সে তার পরিবারের জন্য বিপদজনক হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। কারণ, কখনো কখনো পরিবার থেকে কিছুটা দূরত্ব রাখাও দরকার হয়ে পড়ে রোগীর জন্য।
আরেকটি বিষয়, এই রোগে ভুক্তভোগী কিন্তু শুধু তার একজন সঙ্গীই নয়, কারণ এ রোগের রোগী একইসাথে অত্যাচারীও বটে। তাই সহিংসতা শুরু হয়ে গেলে তা পারিবারিক নির্যাতনের অন্তর্গত হবে। সেজন্য নিরাপত্তার স্বার্থেই তখন অন্যদেরও প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নিতে হবে।
ওথেলো সিনড্রোমের নামটি অপরিচিত শোনালেও এর চিহ্ন আমরা আমাদের আশপাশেই দেখতে পারবো। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। চারপাশে কোনো ব্যক্তির মাঝে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসক ও আইনের আশ্রয় নেওয়া জরুরী।
Previous articleসিলেটে মনোরোগবিদ্যা বিভাগের ষষ্ঠ রেসিডেন্ট ব্যাচ এর অভ্যর্থনা
Next articleমজবুত করুন সম্পর্কের বন্ধন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here