দ্রুত বীর্যপাত ও প্রচলিত কথা

অপরিপক্ক বীর্যপাত (প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন), আগাম বীর্যপাত (আর্লি ইজাকুলেশন) অথবা দ্রুত বীর্যপাত (র‌্যাপিড ইজাকুলেশন) যে শব্দেই বলি না কেন যার হয় তার কাছে এটা তামাশার মতোই লাগে। যেন নিজের শরীরই নিজের সঙ্গে ঠাট্টা করছে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। অতৃপ্তির এক কষ্টের ছাপ পড়ে দাম্পত্য জীবনে।

তাই বলে এটা সবসময় রোগ নয়। কখনো কখনো এমনিতে হয় আবার এমনিতেই সেরে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি তিনজন পুরুষের মধ্যে একজনের এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয় জীবনের কোনো না কোনো সময়।

মানসিক যেসব কারণ এ ধরনের বীর্যপাতের সঙ্গে জড়িত
১. যৌন বিষয়ে অনভিজ্ঞতা।
২. যৌন বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব।
৩. যৌনতা সংক্রান্ত ভ্রান্ত অবৈজ্ঞানিক ধারণা ।
৪. যৌনতা সংক্রান্ত নেতিবাচক ধারণা, যেমন- যৌনতা মানেই খারাপ, এই বিষয়ে চিন্তা করা, আলোচনা করা খারাপ কাজ ইত্যাদি।
৫. হস্তমৈথুন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা, যেমন হস্তমৈথুনে যৌন ক্ষমতা নষ্ট হয়।
৬. সঙ্গিনীকে যৌন তৃপ্তি দেওয়া সংক্রান্ত অনিশ্চয়তায় ভোগা।
৭. ছোটবেলায় যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া।
৮. মাদকাসক্ত রোগী নেশা ছাড়ার পর পর অথবা মানসিক কিছু কিছু রোগের ওষুধ গ্রহণ শুরু করার পর দ্রুত বীর্যপাত হতে পারে।

যেকোনো নেতিবাচক ধারণা যখন মনের উপর হুমকি হিসেবে কাজ করে তখন এক ধরনের উদ্বিগ্নতা অ্যাংজাইটি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা আসে যৌন বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব ও যৌনতা সংক্রান্ত ভ্রান্ত অবৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে। মূলত এগুলো সমাজে প্রচলিত কিছু ধারণা যা বছরের পর বছর ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসে।

সাইকিয়াট্রি সেক্স ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তেমন কিছু ধারণা বা মিথ তুলে ধরছি এ পর্বের লেখায়।

যৌনতা সংক্রান্ত সমাজে প্রচলিত ধারণা বা জনশ্রুতি
১. দ্রুত বীর্যপাত একটি নিরাময় অযোগ্য রোগ।
২. অল্প বয়সে বা বিবাহপূর্ব জীবনে যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করে তারা বিয়ের পরে এই রোগে ভোগে (বিবাহ পূর্ব অত্যাচার বলতে হস্থমৈথুনকে বুঝানো হয়েছে)।
৩. যৌন দুর্বলতার একটি লক্ষণ হলো বীর্য পাতলা হওয়া যা স্বপ্নদোষ বা হস্থমৈথুনের ফলে হয়।
৪. যৌনমিলনে বেশিক্ষণ থাকতে না পারাটা পুরুষের অক্ষমতা।
৫. দাম্পত্য সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য স্ত্রীর যৌন তৃপ্তি অপরিহার্য।
সাইকিয়াট্রি সেক্স ক্লিনিকে আসা দ্রুত বীর্যপাতের সমস্যায় ভোগা রোগীদের শতকরা ৭০% এ ধরনের ধারণা পোষণ করে। এই ৭০% এর প্রায় সবারই শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরদিকে শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলো অন্যরকম।

যৌনতা সংক্রান্ত শিক্ষিত সমাজে প্রচলিত ধারণা বা জনশ্রুতি
১. দ্রুত বীর্যপাত পুরোপুরি মানসিক ব্যাপার।
২. অবচেতন মনে থাকা কোনো দ্বন্দ্ব এ সমস্যার সৃস্টি করে।
৩. খাদ্যাভ্যাস এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
৪. পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হলে এই রোগ হতে পারে।
৫. দাম্পত্য সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য স্ত্রীর যৌন তৃপ্তি অপরিহার্য।
৬. যৌনমিলনে বেশিক্ষণ থাকতে না পারাটা পুরুষের অক্ষমতা।

দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত সবার মধ্যেই এই ধারণাটা প্রবল যে দাম্পত্য সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য যৌন তৃপ্তি গুরুত্বপূর্ণ এবং মিলনে দীর্ঘক্ষণ থাকতে না পারাটা পুরুষের অক্ষমতা। কিন্তু সত্যিই কি তাই ?

বিজ্ঞান অবশ্য ভিন্ন কথা বলে। দাম্পত্য সম্পর্ক শুধুমাত্র যৌন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে না। সেখানে দেওয়া নেওয়ার অনেক কিছুই থাকে। তবে যৌনতা একটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্লিনিকে আসা রোগীদের অনেকেই ডিভোর্সের ঝুঁকি বা হুমকির মধ্যে ছিলেন। কিন্তু ডিভোর্স বেশি দেখা গেছে যেখানে সম্পর্কে অন্যান্য দিকগুলো দুর্বল ছিল তাদের মধ্যে। পাঁচ বছরের অধিক পুরোনো দম্পতিদের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের ঝুঁকি আরো কম লক্ষ্য করা গেছে।

মিলনে দীর্ঘক্ষণ থাকতে পারার সঙ্গে পুরুষের ক্ষমতা অক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নাই। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে পুরুষত্বের সঙ্গে জড়িত হরমোনের রিপোর্ট নরমাল এসেছে। তাই এধরনের সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের অহেতুক হীনমন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। দ্রুত বীর্যপাতের ক্ষেত্রে বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারণা সেরোটনিন নামক জৈব উপাদান কমে গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আর সেরোটনিন অনেক কারণেই কমে যেতে পারে যেমন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, বিষন্নতায় ভুগলে, দুশ্চিন্তায় বা মানসিক চাপে থাকলে ইত্যাদি।

স্বপ্নদোষ বা অতিরিক্ত হস্থমৈথুন এর কোনোটাকেই দ্রুত বীর্যপাতের কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়নি। পর্নোগ্রাফির সঙ্গেও তেমন কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। পর্নোগ্রাফি পূর্বের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সে তুলনায় প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন সেভাবে বাড়েনি।

কোনো খাবারের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে কি না তাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অ্যালকোহল, বিয়ার, মারিজুয়ানা যৌন উত্তেজনা বাড়ায় এবং সময়কেও দীর্ঘায়িত করে। কিন্তু তা সাময়িক। এসব নেশা জাতীয় দ্রব্যে পরবর্তীতে ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যা দেখা দেয়। আর সব কথার শেষ কথা হলো প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য রোগ। তাই এ বিষয়ে হতাশ না হয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

Previous articleডিমেনশিয়া: ভুলে যাওয়া রোগ
Next articleআমার স্ত্রী মিথ্যে কথা বলে !
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here