বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টসের সভাপতি তিনি। সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ও সাবেক কনসাল্টেন্ট (সাইকিয়াট্রি), স্কয়ার হাসপাতাল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্যামপুরের চৌধুরীপাড়ায় তাঁর জন্ম। সম্প্রতি তিনি নিজের জীবন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন মনের খবর-এর সাথে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মামুন মিজানুর রহমান।
মনের খবর: কেমন আছেন স্যার?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: মোটামুটি ভালোই আছি।
মনের খবর: আপনার শৈশবে কী স্বপ্ন ছিল? ছোটবেলা থেকেই কি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: না, একদম ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। বেশ বড় হওয়ার পর ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন দেখা শুরু করি। তবে ছোটবেলায় অন্য নানা ধরনের স্বপ্ন ছিল। এক বয়সে বইয়ের দোকানদার হতে চাইতাম। মিষ্টির দোকানদার হওয়ার কথাও ভেবেছিলাম। এক পর্যায়ে শিক্ষকও হতে চেয়েছি। দশম শ্রেণীতে যখন পড়ি, তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমি কানসাট হাইস্কুলের ছাত্র। আমাদের এলাকার কাছেই সীমান্ত। প্রাণভয়ে ও যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন। আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই তখন মুক্তিযুদ্ধে যান। মুক্তিযুদ্ধে আমরা নানা ক্ষতিরও শিকার হই। এসব ঘটনায় আমি খুব উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। তখন আমার ভেতর এক ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। এরপর যখন রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে যাই। প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ায় তখন থেকে আমার মধ্যে মানুষের সেবা করার প্রবল ইচ্ছা জাগে। আমার মনে হয়েছিল, ডাক্তারি পড়তে পারলে আরো বেশি মানুষের সেবা করা যাবে, সাধারণ মানুষের আরো কাছাকাছি যাওয়া যাবে। এভাবেই আমার মধ্যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তৈরি হয়।
মনের খবর: আপনি শৈশব কতটা আনন্দে কাটিয়েছেন?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: যদি এখনকার ছেলে-মেয়েদের শৈশবের সাথে আমাদের শৈশবের তুলনা করি, তাহলে বলতে হয়, তারা আমাদের তুলনায় অনেকটাই বঞ্চিত। গ্রামের যে সরল জীবন, প্রাকৃতিক প্রাচুর্য, ফসলের মাঠ, এসবের কোনোটাই তারা উপভোগ করতে পারছে না। গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও এখন বঞ্চিত হচ্ছে, কারণ গ্রামও এখন আর আগের মতো সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নয়। আমরা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে মিশার সুযোগ পেয়েছি। দুই মাইল হেঁটে নদী পার হয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, সেটা খুব আনন্দের ছিল। আমবাগানের ভেতর দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য। আমাদের সময় সব স্কুলে খেলার মাঠ ছিল। আমাদের স্কুলের মাঠ ছিল দুইটা। ছোটদের জন্য একটা খেলার মাঠ এবং বড়দের জন্য পৃথক একটা খেলার মাঠ। নিয়মিত খেলা হতো স্কুলে। ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার প্রতি আমার খুব আগ্রহ। সব মিলিয়ে দারুণ শৈশব কাটিয়েছি।
মনের খবর: মেডিকেল কলেজের দিনগুলো নিয়ে কিছু বলুন স্যার।
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: আমি পড়েছি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। সেই দিনগুলো ছিল খুব আনন্দের। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আমাদের সময় মেডিকেল শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমান পদ্ধতির চেয়ে কিছুটা আলাদা ছিল। তখন শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদনকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো। আমাদের কলেজে সারা বছর নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতো। প্রতি বছর সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদযাপিত হতো। আমি খুব এনজয় করতাম। কলেজে আমরা ‘ছাপ’ নামে একটা নাটকের দলও করেছিলাম। আমাদের দল নাটক করতো। এছাড়াও কলেজের ছাত্র সংসদ নাটক মঞ্চস্থ করতো। নাটকের বাইরে আমি গানও গাইতাম। ছোটবেলার খেলাধুলার নেশা তখনও পুরোদমেই ছিল। ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। এত সব ব্যস্ততার ভেতর থেকে বই পড়ার জন্য সময় বের করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার নেশা ছিল, এই নেশাটা এখনো আছে।
মনের খবর: ডাক্তারি পড়ার শুরু থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: ১৯৮১ সালে মেডিকেল কলেজ থেকে আমি পাশ করি। চতুর্থ বর্ষে আমরা শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম পাবনার মানসিক হাসপাতালে। সেখানে গিয় আমার মনোরোগ নিয়ে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়।
মনের খবর: মনোরোগের চিকিৎসক হিসেবে কবে চাকুরি শুরু করেন এবং কোথায় কোথায় চাকুরি করেন?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: ১৯৮৫ সালে আমি সাইকিয়াট্রিতে এফসিপিএসে ভর্তি হই। পাশ করি ১৯৯০ সালে। আমার প্রথম কর্মক্ষেত্র ছিল পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এরপর জাতীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চাকুরি করেছি। ১৯৯৯ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে যোগ দিই, সেখানে ২০০৫ পর্যন্ত ছিলাম। ময়মনসিংহেও আমি প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। ময়মনসিংহ বিএম-এর সহ: সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এছাড়া ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাকের দায়িত্ব দীর্ঘদিন পালন করেছিলাম। ২০০৫ সালের পর আমি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে যোগ দিই। ২০০৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে যোগদান করি। ২০০৯ সালে আমি আবারো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ফিরে আসি। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এছাড়া ২০১২ সাল থেকে পর পর দুইবার বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টসের সাধারণ সম্পাদক হই এবং ২০১৭ সালে এসোসিয়েশনে সভাপতি মনোনিত হই।
মনের খবর: দীর্ঘদিন এসোসিয়েশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন। সমস্যা এবং সহযোগিতার বিষয়ে কিছু বলুন।
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: যেকোন সংগঠনের মধ্যেই কিছু মতপার্থক্য থাকে। তবে বিএপি সেই অর্থে একটু ভিন্ন রকম। এখানে কাজ করে আমার সংগঠনের কাছ থেকে কোন অসহযোগিতা পাইনি। বরং সকলেই সব সময়ই আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে আমার শ্রদ্ধাভাজন সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম রব্বানী, আমার সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুগণের ব¯‘নিষ্ঠ পরামর্শ এবং আমার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল ও অন্যান্য সম্পদক ও সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ আমাকে সব সময় উৎসাহিত করেছে। শিক্ষাগুরু অধ্যাপক হেদায়তুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী ও ইসি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে।
মনের খবর: জীবনে আপনি কাদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন?[/int-qs]
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: সত্যি বলতে, যেহেতু আমি চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত, সেহেতু মাদার তেরেসা আমার আদর্শ। মাকেও আমি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছি। এছাড়াও প্রয়াত বিচারপতি মোঃ হাবিবুর রহমান, মার্টিন লুথার কিং এবং আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ আমার আদর্শ।
মনের খবর: সম্প্রতি আপনি আমেরিকার এসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টসের বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগ দিয়ে এসেছেন? সে সম্পর্কে এবং অন্যান্য দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও আমাদের অবস্থান নিয়ে কিছু বলুন।
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: শুধু আমাদের দেশ নয়, বড় দেশগুলোর সাথে ছোট ছোট দেশগুলোর পরিস্থিতির ব্যবধান অনেক। বিশেষত স্বাস্থ্য খাতে সেই ব্যবধান অনেক। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সেই পার্থক্য অনেকাংশেই বেশি। প্রেসিডেন্ট ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন (ডব্লিউপিএ) হেলেন হারমেনের সঙ্গে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের এজিএম (এপিএ- ২০১৮) গত ৫ থেকে ৯ মে নিউইয়র্কে আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টসের বার্ষিক সাধারণ সভায় বাংলাদেশের পক্ষে আমি অংশগ্রহণ করি। সেখানে আমেরিকানদের যে অগ্রগতি দেখেছি, তা আমাদের তুলনায় অনেক অনেক এগিয়ে। সেই সাধারণ সভায় আমেরিকারই তেরো হাজার সাইকিয়াট্রিস্ট যোগ দিয়েছেন। অথচ আমাদের দেশের প্রায় আঠারো কোটি লোকের জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন মাত্র ২৪০ জন। এছাড়া নার্স, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও অন্যান্য জনবল ও প্রযুক্তির দিক থেকেও আমরা অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি।
মনের খবর: মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে আমাদের রাষ্ট্রের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: এক্ষেত্রে প্রধান কাজ হলো, গ্রামের মানুষকেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে হবে, যেহেতু দেশের ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে অবশ্যই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সাথে অঙ্গীভূত করতে হবে। এ বিষয়টি অবশ্য অনেকটা এগিয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় অবকাঠামোর দিক থেকে আমরা অনেকটা এগিয়ে গেছি, কিন্তু আমাদের জনবলের অভাব। ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট, অফিস সহকারী, ঔষধ ইত্যাদি বাড়াতে হবে।
মনের খবর: মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো স্বপ্ন আছে?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা কুসংস্কার। নানা কুসংস্কারের কারণে বেশির ভাগ মানুষ মানসিক রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রায় সবার মধ্যে এ কুসংস্কার রয়েছে। এই কুসংস্কার যদি দূর করা যায়, তবে মানুষ মানসিক সমস্যায় ডাক্তারের কাছে যেতে সংকোচ করবে না, ফলে তারা রোগের ভোগান্তি থেকে অনেকটাই বাঁচতে পারবে। আমি এবং আমার সংগঠন (বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস) কুসংস্কার প্রতিরোধে কিছু কাজ করে যাচ্ছি। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, নিয়মিত সিএমই ও মানসিক রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন দিবস পালনের মাধ্যমে। সরকারিভাবেও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন। সম্প্রতি সরকারের এনসিডি বা নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ প্রগ্রামে মানসিক রোগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মনের খবর: মনোরোগ বিষয়ে আপনার হাতেখড়ি কিভাবে হয়?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: মনোরোগ হিসেবে আমার শিক্ষা গুরু আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক হেদায়েতুল ইসলাম। তাঁর কাছেই আমার হাতেখড়ি এবং সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে বড় হয়ে ওঠা। ১৯৮৬-৮৮ইং আমি তাঁর সহকারী হিসেবে তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ও স্নেহ মমতায় কাজ করেছি এবং অদ্যবধি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে তাঁর স্নেহভাজন হিসেবে বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সাথে নিয়োজিত আছি। অন্যান্যদের মধ্যে সাইকিয়াট্রিতে আমার ক্যারিয়ার গড়তে যাদের বিশেষ অবদান রয়েছেন তাঁরা হলেন প্রায়ত অধ্যাপক নাজিমুদ্দৌলা চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম, অধ্যাপক এম এ মুনিব, অধ্যাপক হামিদা আখতার বানু (সাইকোলজিস্ট), প্রায়ত অধ্যাপক সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. দেওয়ান ওয়াহিদুন্নবী (প্রবাসী), অধ্যাপক আব্দুস সোবহান প্রমুখ।
মনের খবর: মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে আপনার মনে কোনো খেদ আছে কি?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: এক্ষেত্রে আমার প্রধান খেদ হলো, যারা সাধারণ, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, অসহায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষ, তাদের মধ্যে কুসংস্কার থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও মানসিক রোগ নিয়ে কুসংস্কার রয়েছে। তাঁরা তাদের পরিবারে কোন মানসিক রোগী থাকলে তা গোপন করতে চান, নিজে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না, পরিবারের কোন সদস্য মানসিকভাবে অসুস্থ’ হলে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে চান না। শিক্ষিত মানুষের এই মানসিকতা আমাদের সকলের জন্য লজ্জাজনক ও কষ্টদায়ক।
মনের খবর: সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছোটবেলা থেকেই আপনি যুক্ত, আপনার প্রিয় লেখক-শিল্পী কারা?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: প্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই আছেন তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, লিও তলস্তয়, মার্ক টয়েন, শামসুর রাহমান, সুনিল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম। প্রিয় গায়কের কথা বলা কঠিন, কারণ অগণিত শিল্পী আছেন যাদের গান আমাকে মুগ্ধ করে। তবু বিশেষভাবে ভালো লাগে শচীন দেব বর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নিলুফার ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী আর রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে সুবিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, চিনময় চট্টপাধ্যায়, এদের কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত আজও আমাকে মুগ্ধ করে। নজরুল সঙ্গীতের শিল্পীদের মধ্যে ফিরোজা বেগম, মানবেন্দ্র প্রমুখ নিঃসন্ধেহে অন্যতম । প্রিয় অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে আছেন ফেরদৌসী মজুমদার, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হুমায়ুন ফরিদী।
মনের খবর: আপনি বলছিলেন ছোট বেলা থেকেই বই পড়ার নেশা। কোন একটি বিশেষ বই কি আপনার জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: হাজার হাজার ভাল বইয়ের মধ্যে একটি বইকে ভাল বলে চিহ্নিত করা বড়ই কঠিন কাজ। তারমধ্যে আমি বলব প্রাত্যহিক জীবনে অন্যান্য বিষয়গুলোর মত রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান যেন যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মনের খবর: নবীন মনোচিকিৎসকের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: নবীন মনোরোগের ডাক্তারদের প্রতি আমার প্রচণ্ড আগ্রহ। তাদের বেশিরভাগ আমাদের ছাত্র। তাদের নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। তুলনামূলকভাবে তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেশে-বিদেশে তারা সুনাম কুড়াচ্ছেন। আমাদের দেশে যেহেতু এখনো সাইকিয়াট্রি এতটা জনপ্রিয় নয়, মনোরোগীরাও সহজে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না, ফলে তরুণদের বলবো, তারা যেন মনোরোগের চিকিৎসা বিষয়ে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে তাদের উদ্যোগী হতে হবে। চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদেরকে আরো ধৈর্যশীল, সহানুভূতিশীল ও আন্তরিক হতে হবে এবং চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি গবেষণাধর্মী কর্মকা-ে আরও বেশী মনোনিবেশ করতে হবে।
মনের খবর: ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: গত দুই দশকে দেশে মনোরোগের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। এখন দেশে অনেক মানসম্মত ঔষধ তৈরি হচ্ছে। মনোরোগের ঔষধ এখন রফতানিও হচ্ছে। ঔষধ কোম্পানিগুলোকে বলবো, তারা যেন মানুষের আর্থিক সক্ষমতার দিকে খেয়াল রাখে। যেহেতু মনোরোগের ঔষধ সাধারণতঃ দীর্ঘদিন ধরে খেতে হয় এবং আমাদের দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা পাশ্চাত্যের চাইতে অনেক কম তাই এসব ঔষধের মূল্য যেন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা হয়। প্রয়োজনে মনোরোগের ঔষধের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে অথবা যাদের দিনের পর দিন ঔষধ খেতে হয়, তাদের জন্য ভর্তুকি দিয়ে কিছুটা ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
মনের খবর: অনেক ধন্যবাদ স্যার।
ডা.ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: আপনাকে এবং মনের খবর-কেও অনেক ধন্যবাদ।