মেয়েদের “সিন্ডেরেলা কমপ্লেক্স” উপসর্গ নিয়ে সম্ভবত বাংলাদেশে আমারই প্রথম আলোকপাত। এর আগে কোন সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্ট এ নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে মনে হয়না। রুপে, গুণে, মেধায় অনন্যা তরুণী মাঝে সিন্ডেরেলা সিনড্রোম দেখা যায়।
এ রোগে নারী নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং প্রতিষ্ঠিত হবার লক্ষ্যে সারাক্ষণ মনের মতো একজন- বন্ধু, প্রেমিক বা স্বামীকে কামনা করে। তার ধারণা স্বপ্নের সেই সুপুরুষ আসবে এবং তার উপর ভর করে সে পৌঁছে যাবে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। দিনের পর দিন কাঙ্ক্ষিত সুপুরুষের সান্নিধ্য কামনায় সে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। নিজের সকল দক্ষতা, যোগ্যতা, প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস ভুলে গিয়ে অনেকটা পটের বিবি’র ন্যায় সেজেগুজে বসে থাকে মনের মানুষটির প্রতীক্ষায়। একেই বলে সিন্ডেরেলা কমপ্লেক্স। সিন্ডেরেলা কমপ্লেক্স জানার আগে আসুন এরকম একজন রোগীর প্রেজেন্টেশনটা একটু দেখে নেই।
এক.
আনিকা (ছদ্মনাম) ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর শেষ সেমিস্টারের ছাত্রী। দেখতে যেমন অপরুপা, মেধা-গুণে, আচার-আচরণে তেমনি অতুলনীয়া। এ পর্যন্ত সকল সেমিস্টারে এ গ্রেড। ইদানীং আনিকাকে পড়শুনায় খানিকটা অমনোযোগী দেখা যায়। সে আনমনে সারাক্ষণ প্রেম করার কথা ভাবছে। মনের মতো একটি ছেলেকে খুঁজছে। তার পক্ষে একা চলা আর সম্ভব নয়, উচিতও না। পাশে একজন মনের মতো মানুষ এবার চাইই চাই। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে সে বলেছে তার মনের কথা। একজন পুরুষ মানুষ আসবে। সে হতে পারে তার প্রেমিক বা স্বামী। এমন ভাবনার কারণ হিসেবে সে জানালো, “পুরুষ মানুষটি সাথে থাকলে সে তার পড়াশোনা শেষ করতে পারবে অনায়াসে, এমনকি সু-প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। আর না হলে সম্ভব না। তার সাজগোজ ও নজরে পড়ে সবার।
বান্ধবী অবাক, আত্মপ্রত্যয়ী যে আনিকা এতোদিন একাই এতোদূর আসলো। যে আনিকা বান্ধবীদের আড্ডায় প্রেম বা বিয়ের প্রসংগ আসলেই তাচ্ছিল্য আর ঠাট্টা-তামাশায় মেতে রইতো, আজ তার মুখে একি কথা! আনিকার বান্ধবী, আনিকার মা বাবা’কে বিষয়টি পাড়লো। তারা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। এতোদিনের আত্মপ্রত্যয়ী আনিকা হঠাৎ করে বিয়ে বা প্রেমের ভাবনায় মগ্ন হয়ে রইলো! তারা এতে কোনমতে সায় দিলেন না। তাদের মতে পড়াশোনাটা শেষ করে বিয়ে করলেই বরং ভালো। তাছাড়া যে ছেলেকে সে বিয়ে করবে বা যার সাথে তার প্রেম হবে সেই ছেলে যদি মনের মতো না হয়, যদি ওভাবে তার ক্যারিয়ারের প্রতি কো-অপারেটিভ না হয় তাহলে তো হিতে বিপরীত হবে।
বিয়ের পর পড়াশোনা, চাকুরী শিকেয় উঠেছে এমন ঘটনা ভুরি ভুরি অথচ কনে দেখার সময় পাত্র ও পাত্রের মায়ের মুখে ছিলো ফুলঝুরি, “মেয়েকে আমরা পড়াবোই, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবোই। বিয়ের পর ইউ টার্ণ” এসব তারা আনিকা কে বার বার বুঝাতে যেয়ে ব্যার্থ হলেন। আনিকা তার বিয়ের ভাবনা মাথা থেকে সরাচ্ছেনা। তার কনফিডেন্স লেভেল কমে গিয়েছে। পাশে কাউকে ছাড়া সে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। আনিকা সারাক্ষণ কল্পনায় ভেসে বেড়াতে লাগলো সেই সিন্ডেরেলা গল্পের নায়িকার মতো। যে কিনা স্বপ্নে বিভোর ছিলো, একজন রাজপুত্র আসবে, তাঁকে দেখে মুগ্ধ হবে। তারপর তাকে সাথে নিয়ে উড়ে যাবে সুখের ঠিকানায়।
দুই.
আনিকাকে নিয়ে আনিকার বাবা মা সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হয়েছেন। সারাজীবন ফার্স্ট হওয়া আনিকা হঠাৎ কেনো এতো ‘আত্মবিশ্বাসহীন’, ‘আত্মপ্রত্যয়হীন’ হয়ে গেলো। সঙ্গী ছাড়া নাকি সে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেনা” আসলে তার উদ্দেশ্য কি? ও কি তাহলে কাউকে ভালোবাসে? নাকি গোপনে কোন অবৈধ সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে বিপদে পড়ে আছে? তারা সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে আনলেন এ ভরসায় যে সাইকিয়াট্রিস্টকে আনিকা হয়তো সব কিছু খুলে বলবে।
সাইকিয়াট্রিস্ট আনিকার সাথে একান্তে আলাপ করলেন। বেশ কয়েকটি দীর্ঘ সেশন নিলেন। তার আত্মবিশ্বাসহীন, আত্মপ্রত্যয়হীন হবার যুক্তি গুলো শুনলেন। অবশেষে সাইকিয়াট্রিস্ট আনিকার বাবা মা’কে আশ্বস্ত করলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই’। আনিকা ইন্টারেস্টিং “সিন্ডেরেলা কমপ্লেক্স”, ‘Cinderella Complex’ -এ ভুগছে। মেধা, রুপে, গুনে অনন্যা মেয়েদের মধ্যে সিন্ডারেলা কমপ্লেক্স বিরল নয়। আমাদের আশে পাশে অনেক আছে। কিন্তু কেউ যথাযথ ভাবে রিপোর্ট করে না, তাই অজানা রয়ে যায়। আত্মবিশ্বাসহীন, আত্মপ্রত্যয়হীন হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার আশায় মেয়েরা প্রেমে পড়ে, ঘর বাঁধে, কিন্তু সমস্যায় পড়ে। যে আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রেম বা বিয়ে করে বাস্তবে দেখা যায় উল্টোটা হয়। সম্পর্ক গুলো আরো জটিল হয়।
শেষকথা:
সিন্ডেরেলা কমপ্লেক্স এর ফলে মেয়েরা মেধা, যোগ্যতা, রুপ, গুণে অনন্যা হওয়া সত্ত্বেও সে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে প্রতিষ্ঠা পেতে বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পুরুষের সহায়তা’কে একমাত্র অবলম্বন করে। তারা মনে করে একজন পুরুষ নাহলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। ফলে সে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে অধীর আগ্রহে একজন স্বপ্নের পুরুষের কামনা করতে থাকে। সেই স্বপ্নের পুরুষটি এসে তাকে নিয়ে যাবে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে পুরুষের উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়া সিন্ডারেলা কমপ্লেক্স নিয়ে উন্নত বিশ্ব সচেতন।
চিকিৎসা:
যেহেতু মূল ব্যপার হলো আত্মবিশ্বাস হারানো তাই এর একমাত্র চিকিৎসা সাইকোথেরাপি। তার সাথে কথা বলতে হবে, ধৈর্য ধরে তার যুক্তি গুলো শুনতে হবে। তার সকল ভ্রান্ত যুক্তিগুলো সে যাতে নিজে থেকেই খন্ডন করতে পারে এ ব্যাপারে তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। সাইকোথেরাপির মাধ্যমে একজন তরুণী বা নারী তার হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী বা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে আবার পথ চলা শুরু করতে পারেন, পৌঁছাতে পারেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়।
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে