হিস্টিরিয়া চিকিৎসা: প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপ

0
274
হিস্টিরিয়া চিকিৎসা: প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপ

ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার পর যখন ডাক্তার তাকে বসিয়ে বাবা-মাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন, তখন একটা আরামের শ্বাস নিল অন্তু (ছদ্মনাম)। ডাক্তার আংকেলকে একটু ভয় ভয় লাগছিল শুরুতে কিন্তু এখন আর লাগছে না। স্বাভাবিক গলাতে বড়ো মানুষের মতোই উনি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলেন, এতে খুশি হয়ে অন্তু বলতে থাকল তার সমস্যার কথা।

অন্তু গত এক মাস আগে হাসপাতালে খিচুঁনির লক্ষণ নিয়ে ভর্তি ছিল। হাসপাতাল থেকে ছুটির সময়ে রোগের বিষয়ে ওর বাবা-মাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এই রোগের নাম হিস্টিরিয়া, এটা মানসিক রোগ। এগারো বছরের ছেলের মানসিক রোগ হওয়ার বিষয়টা মানতে পারছিলেন না অন্তুর বাবা-মা। ঢাকা শহরের খুব নামকরা বেসরকারি হাসপাতালটির ডাক্তারদের ওপর রাগই উঠে যাচ্ছিল তাঁদের। অনেক প্রক্রিয়া পার হয়ে এখন নিয়ে এসেছেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু অন্তুর সেটা নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধা হচ্ছে, প্রতিদিন বিকেল বেলায় হুজুর আংকেলের কাগজ পুড়িয়ে নাকে ধোঁয়া দেয়াতে; হাতে, পেটে বাঁধা তাবিজগুলোতে।

ডাক্তার আংকেলের সাথে দুটো কথার পরই অন্তু গড়গড় করে আগে বলে নেয় ‘আংকেল আম্ম-ুআব্বুকে প্লিজ বলে দিয়েন কাগজ পোড়া আমাকে না দিতে। যেদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় আসছি সেদিন থেকে আরবি পড়ানোর হুজুর এটা দিচ্ছেন ‘বদ জ্বিন’ তাড়াতে। আমার খুব কষ্ট হয়।’ ডাক্তার অবশ্য অবাক হলেন না। বিশ বছর ধরে এই পেশায় অভিজ্ঞতা তাঁর, অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই এটা দেখেছেন। অন্তুর বাবা-মা’র সাথে যখন কথা বললেন তখন জানতে পারলেন আরো বিস্তারিত।

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অন্তু তাদের একমাত্র ছেলে। নামকরা স্কুলে ভর্তি করার জন্য একই শ্রেণিতে আবার ভর্তি করানো হয়েছে তাকে। স্কুলের পড়া সব হয়ে গেছে ধরে নিয়েছেন বাবা-মা। আগের স্কুলে মোটামুটি ফলাফল করা অন্তুর অঙ্কের কম নাম্বারে অসন্তুষ্ট হলেও সেটা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে এখন প্রথম দুই-তিনজনের মধ্যে অন্তুকে দেখতে চান তাঁরা। কিন্তু এক মাস এক সপ্তাহ আগে থেকেই দেখছেন ছেলে কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। বিকেল বেলা পড়তে বসতে গেলেই কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। তারপর শুরু হয় চিৎকার দিয়ে বেশ কিছক্ষুণ হাত-পা টান টান করে শরীর ঝাঁকুনি দেয়া। প্রায় ঘণ্টাখানেক এই অবস্থা থাকে। ভয়ে অস্থির বাবামা তখন হাতে-পায়ে-বুকে তেল মালিশ করেন, মাথায় পানি ঢালেন। এরকম হওয়া শুরু হতেই হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। হাসপাতালে প্রথম দিন ইঞ্জেকশন দেয়ার পর কমে যায় ঠিকই, কিন্তু দইুদিন পর স্কুলে যাওয়ার আগে আবার একই অবস্থা। হাসপাতাল থেকে বলে দেয়া রোগটা তারা মানতে পারেননি, আর দিনের পর দিন সমস্যাটা বেড়েই যাচ্ছিল।

একমাত্র ছেলের এই অবস্থা দেখে দিশেহারা ছিলেন বাবা-মা। যতজন পরিচিত ডাক্তার আছেন সবার সাথে কথা বলেছেন, চারজন বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন, মানসিক অবস্থা ভালো করার সাধারণ পরামর্শ শুনে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছেন, যা যা খেতে চায় খাইয়েছেন, উপহার দিয়েছেন অনেক। কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখছিলেন না। অন্তুর আরবি পড়ানোর হুজুর প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন, ‘আপনারা তো শহরে থাকেন, পড়ালেখা জানেন, আমার কথা শুনতে চাইবেন না, কিন্তু আপনাদের একমাত্র ছেলে, কত রকম নজর ওর উপর, নামি স্কুলে পড়তেছে, কোনো সদকা দেন নাই, আর এলাকাও এখানে ভালো না, অনেক বাসায়ই আমি জানি হঠাৎ হঠাৎ জিনিসপত্র হারায়, এখানে আছে এক-দুইজন বেয়াদব জ্বিন, বিশেষ করে ছাত্রদের বিরক্ত করে। আপনারা রাজি হলে বেয়াদ্দপটারে আমি তাড়াইতে পারি।’ এই কথায় মনটা খচখচ করছিল বাবা-মায়ের; ভাবলেন, চলুক না উনি যা যা করতে চান।

চিকিৎসার এক পর্যায়ে অন্তু আরো সহজ হয়ে জানাল তার অঙ্কভীতির কথা, খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে এটা নিয়ে ভয়ের কথা। আর এই অসুখ শুরুর আগে তার ক্লাসে কয়েকজনের তাকে খেপানো এবং খেলার মাঠে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার কথা। সব কিছু মিলিয়ে তার স্কুলটাতে আর যেতে ইচ্ছা করছিল না। আগের স্কুলের বন্ধুরাও নাই যে তাদের সাথে কথা বলবে। বাবা-মা তাকে অনেক আদর করে কিন্তু একটা কথা বলেই ‘তোমাকে কিন্তু প্রথম, দ্বিতীয় হতেই হবে আব্বুসোনা।’ ছোটবেলা থেকেই সে দেখে আসছে মা তার সব কিছু করে দেয়, খুব একটা বাইরে যেতে দেয় না-ভয় পায়। তার একবার হাঁচি-কাশি হলেও বাবা উত্তেজিত হয়ে যায়, মা কে বলে ‘কী করো, বাচ্চাকে দেখে রাখতে পারো না।’ অন্তু এইসব মিলিয়ে যেটুকু বোঝে যে, তার এই স্কুলের ঘটনা বাবা-মাকে বলা যাবে না।

সবকিছু যাচাই করে ডাক্তার অন্তুর বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলেন ‘ওর এই রোগটা ওর এই চাপ থেকে হয়েছে। যখন মনের কোনো কষ্ট মোকাবেলা করা যায় না আবার সহ্যও করা যায় না তখন এমন লক্ষণ দেখা যায়। শারীরিক কোনো অসুখ মোতাবেক এখানে পরীক্ষার কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না, তাই রোগীর কাছের মানুষদের কাছে খুব ধাঁধার মতো লাগে এই রোগকে।’ অন্তুর মা তখন প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু দেখেন অন্তুর খিচুঁনিটায় এখন আরো কিছু লক্ষণ যোগ হয়েছে। সে বাচ্চাদের মতো আচরণ করে, এমনভাবে একদিকে তাকিয়ে থাকে যেন সামনে একজন মানুষকে দেখছে। এরকম কেন হচ্ছে? আমি তো জ্বিনে ধরার লক্ষণ অন্যরা যেরকম বলে সেরকমটাই দেখতে পাচ্ছি ওর মধ্যে। আর আপনার চিকিৎসাতেও কোনো ফল দেখছি না।’ ডাক্তার তখন বললেন, ‘দেখেন, অন্তুর যেই বিষয়গুলো নিয়ে চাপ, সেগুলো এতদিন সামনেই আসেনি। তার ওপর ও বারবার এরকম মন্তব্য শুনেছে যে এরকমটা জ্বিনে ধরার লক্ষণ। আপনাদের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ওর মনের গভীর অংশ বা অবচেতনে প্রভাব ফেলেছে, ফলে ওর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে এইরকম। ওর চাপগুলো নিয়ে ঠিকমতো কাজ করা গেলে আর লক্ষণগুলোকে উপেক্ষা করতে পারলে দেখা যাবে এসব বন্ধ হয়ে যাবে।’

আরো অনেক ব্যাখ্যার পর সেদিনকার মতো অন্তুর বাবা-মা বের হয়ে আসলেও খুব একটা মানতে পারলেন না, তার ওপর হুজুর পনেরো দিন সময় চেয়েছেন, উনাকে না করলে সেটা না আরো ক্ষতির কারণ হয়। তবে অন্তুর অনুরোধে ভয়সহই কাগজ পোড়ানো ধোঁয়া দেয়াটা বন্ধ থাকল। ডাক্তারের পরামর্শমতো অন্তুকে নিয়ে তারা বসে আলাপ করলেন লেখাপড়ার বিষয়ে, তাকে আশ্বস্ত করলেন যে-অন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাক, ফলাফল যাই হো তাতে যেন ভেঙে না পড়ে। আর নতুন স্কুলে কীভাবে বন্ধু বানাবে সেটার বিষয়ে গল্প করলেন বাবা। ম্যাজিকের মতো কিছু হলো না, আবারো পড়তে বসে অন্তুর মাথাব্যথা, মাথা ঘরুানোসহ চোখ ঝাপসা লাগল কিছুিদন, কিন্তু বাবা-মা ভরসা দিয়ে গেলেন। পরেরবার ডাক্তারের কাছে খুশি মনে বাবা-মা গেলেন-অন্তু পড়ালেখা করছে, স্কুলে যাচ্ছে, ঐ খিঁচুনি আর নেই। তবে উনারা ডাক্তারকে জ্বিন এবং বদ নজরের বিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ডাক্তার এই প্রশ্ন বহুবার শুনেছেন এবং উত্তর তাঁর জানা, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁদের পেশা তাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়ই। তাদেরকে তিনি এবার বললেন, ‘আমাদের সমাজে মানসিক রোগের লক্ষণগুলোকে ‘খারাপ নজর’,’বাতাস লাগা’, ‘জ্বিনের আছর’ হিসেবে মনে করা হয়। অনেক সময় এই ধারণার ভিত্তিতে চিকিৎসা চলে। আপনাদের ক্ষেত্রে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আপনাদের স্বাভাবিক উৎকন্ঠার জন্য এই ধারণা কাজ করেছে। আমার বিশ্বাস, আপনাদের বিশ্বাস যাই থাকুক সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু আমার পেশাগত জ্ঞানে আমাকে রোগীর ভালোটা দেখতে হবে। জ্বিন ছাড়ানোর চিকিৎসায় যত সময় ব্যয় করতেন তত ওর ক্ষতি হতো, পড়ালেখায় আরো পিছিয়ে যেত, লক্ষণ বেড়ে যেত, আপনারা ওর চাহিদাকে প্রশ্রয় দিতে থাকতেন, আরো সমস্যা বাড়ত।’

হিস্টিরিয়া বা কনভার্সন ডিজঅর্ডারে প্রচলিত ঝাড়ফুঁক, তাবিজ প্রয়োগের যে ঘটনা ওপরে তুলে ধরলাম সেটা শহরের পটভূমিতে; গ্রামে বা মফস্বলে এই চিত্র আরো জটিল হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে চিকিৎসকের, মনোবিদের কাছে যাওয়ার উপায় অথবা মনোভাব যেমন থাকে না তেমনি তাদের কাছে রোগ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা বা চিকিৎসা প্রদান করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসা পারে এই তথ্যকে শক্তিশালী করতে যে-‘রোগটি জ্বিন-ভূত‚ বা বদ নজরের প্রভাবে হয় না এবং ঝাড়ফুঁক এটার চিকিৎসা না।’

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে


rolex replicasrelojes vital profit is without question watertight and automatic.replica patek philippe genuinely tough developing also running standard is going to be look deliver the results also long-term longevity the protection.cheap vapesstores.ru at the pursuit of a perfect loveliness in the process the very best combination to do with effectiveness authentic wonderful build.many years of brilliant creativeness introduced the discount https://www.billionairereplica.ru.who sells the best pamreplica.ru can easily meet the needs on engineering,sports and also business.https://www.sevenfridayreplica.ru/ official site.

Previous articleরোমান্স বাড়াতে হলে সঙ্গীর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করুন
Next articleএকই ঔষধ অনেক দিন ধরে খাচ্ছি
ডা. সৃজনী আহমেদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, মগবাজার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here