‘নিদ্ নাহি আঁখি পাতে’ এ কথাটি যেন প্রবীণদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ৬০ বছর বয়স্ক অধিকাংশ প্রবীণদের মধ্যে কম-বেশি ঘুমের সমস্যা থাকে। এই সমস্যা যদিও বয়স্ক মানুষের জীবনে একপ্রকার প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় নিয়ম হিসেবে আসে, তারপরও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব তাঁদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার অন্তরায়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ঘুমের সমস্যা অল্প বয়স্ক মানুষের মধ্যেও হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ঘুমের নানা সমস্যা দেখা যায়। ঘুম মূলত আমাদের শারীরবৃত্তীয় একধরনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করে। ঘুমের সময়ে আমাদের শরীরের কিছু রাসায়িক পদার্থের (Neurotransmitter) সমন্বয় ঘটে ও ক্ষতিকর পদার্থের তৈরি বন্ধ থাকে। ঘুম থেকে ওঠার সময় এসকল রাসায়িক পদার্থের সমন্বয়ের ফলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে।
অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মের মতো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের গুণগত ও পরিমাণগত মানও দুর্বল হতে শুরু করে। ঘুম আসলে গভীর ও হালকা ঘুম-এ দু-ধরনের ধাপে হয়ে থাকে যা প্রায় দুই ঘণ্টা পর পর চক্রাকারে আসতে থাকে। গভীর ঘুমেরও আবার চার ধরনের পর্যায় থাকে। গভীর ঘুমের সময়ই মূলত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পুনর্বিন্যাস ঘটতে থাকে। এর সঙ্গে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ যেমন : হরমোন উৎপাদন, নিঃসরণ, ক্ষরণ ইত্যাদি যুক্ত থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গভীর ঘুমের থেকে হাল্কা ঘুমের পরিমাণ বেড়ে যায় এবৎ অনেক সময় গভীর ঘুমের চতুর্থ বা সবচেয়ে গভীর পর্যায়টি অনুপস্থিত থাকে। এই চতুর্থ পর্যায়ের সঙ্গে আমাদের স্মৃতিশক্তিও জড়িত থাকে এবং গভীর ঘুম কমে যাওয়ার প্রভাব মানুষের স্মৃতিশক্তির ওপরেও পড়ে।
বয়স বাড়লে পর্যায়ক্রমিক হারে মানুষের শরীরে সর্বাঙ্গীণ পরিবর্তন দেখা দেয়। বয়সজনিত হরমোনের ক্রিয়াকলাপের বদল, বিশেষ করে মেলাটোনিন এবং কর্টিসলের পরিবর্তন আমাদের ঘুমের গুণগত মান এবং তার কার্যকলাপের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। কাজেই নিদ্রাহীনতার কারণের মধ্যে-
- বয়স বৃদ্ধির ফলে শারীরিক ও হরমোনের বিভিন্ন পরিবর্তন
- শারীরিক নানাবিধ দীর্ঘমেয়াদি রোগ
- বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন-উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, স্মৃতিভ্রংশতা
- বিভিন্ন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- অবসর সময় কাটানো বা কোনো নির্দিষ্ট কাজ না থাকা
- অসময়ে ঘুমানো, ঘুমের খারাপ অভ্যাস
- অতিরিক্ত চা, কফি কিংবা অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ২৫ ভাগ প্রবীণ যাঁদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি, তাঁরা ঘুমের সমস্যয় ভোগেন। বিশেষত পুরুষের হার এক্ষেত্রে একটু বেশি কারণ মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোনের মাত্রা বেশি থাকায় ঘুমের প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ঘুমের সমস্যার মধ্যে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়া, রাতে বিছানায় গেলে ঘুম আসতে না চাওয়া, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া ও পরে আর ঘুম না আসা, সারাদিন চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাধারণভাবে ঘুমোতে যাওয়ার পরে একজন মানুষের ঘুম আসতে প্রায় ১৫ মিনিটের মতো সময় লাগে।
নিদ্রাহীনতার আক্রান্ত মানুষের দীর্ঘ সময় চেষ্টার পরও ঘুম আসে না। যার ফলে তাঁরা তাঁদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। খিটখিটে মেজাজের প্রভাব তাঁদের পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও পড়ে। আবার নিদ্রাহীনতার রোগীরা এ সমস্যার কারণে খুবই চিন্তিত হয় পড়েন। কতক্ষণ ঘুম হলো কিংবা হলো না, এ নিয়ে ভাবতে থাকেন। কেউ কেউ কত সময় ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করেছেন তা নিয়েও ভাবেন। ঘুমের এ ভাবনাও কিন্তু ঘুম পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এর ফলে তাঁদের অবস্থার ক্রমশই অবনতি ঘটতে থাকে।
লাগাতার নিদ্রাহীনতার ফলে মানুষের মধ্যে অবসাদ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ভয় ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দেয়। কাজেই ঘুমের সমস্যার রোগীকে নিদ্রাকালীন পরিবর্তনগুলো সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া প্রয়োজন। বয়সের সাথে ঘুমের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়। মাঝে মাঝে ঘুম না হলে মস্তিষ্কের মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয় না। ঘুম না হওয়ার চিন্তা না করলেই বরং ঘুম ভালোভাবে হয়। অনেক বয়স্ক লোক ঘুমের সমস্যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের ঔষধ কিনে খান। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ঘুমের ঔষধ ব্যবহার করলে ঔষধের কার্যকারিতাও কমে যায়। তাই ঘুমের সমস্যার জন্য যা করতে হবে তা হলো-
- ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করতে হবে ও ঝোল জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।
- চোখে ঘুম এলে বিছানায় যেতে হবে।
- ঘুমানোর দুই-তিন ঘণ্টা আগে টেলিভিশন, কম্পিউটার, মুঠোফোন ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে ও সম্ভব হলে শোবার ঘর থেকে সবরকম যন্ত্রপাতি সরিয়ে রাখতে হবে।
- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে কারণ ঘুমানোর সময় এবং ঘুম থেকে ওঠার সময় নির্দিষ্ট থাকলে তা মানুষের প্রাত্যহিক কাজকর্ম যথাযথভাবে করতে সাহায্য করে।
- বিকাল পাঁচটার পর থেকে চা-কফি বা চকোলেট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে ও অন্তত প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে।
- ঘুমানোর আগে কুসুম গরম পানিতে গোসল করা যেতে পারে।
- শোবার ঘর সহনীয় তাপমাত্রায় রেখে, বিছানায় শুয়ে ১৫-২০ বার গভীর শ্বাস নেয়া, এরপরও যদি ঘুম না আসে তবে বিছানা থেকে উঠে অন্য ঘরে যাওয়া, বইপড়া বা পছন্দের গান শোনা যেতে পারে।
- দিনের বেলায় ঘুম বা ঝিমানো এড়িয়ে রাতের বেলায় পর্যাপ্ত ঘুমানো একান্ত জরুরি।
- অ্যালকোহল কিংবা অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য এড়িয়ে চলা দরকার।
ওপরের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও যদি ঘুমের সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক। নিদ্রাহীনতা যদি কোনো মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে তবে রোগের প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত চিকিৎসাই পারে একজন প্রবীণকে নিদ্রাহীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে