মাইকেল জ্যাকসন: মুন ওয়াকার অব দ্যা আর্থ

মাইকেল জ্যাকসন

তাঁর এপিটাফের দ্বিতীয় লাইনে বড় বড় করে লেখা, ‘The King 0f Pop’। বাকি পৃথিবীর কাছে যিনি পপসম্রাট, পরাবাস্তবতার জগতের সুলতান সেই মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন একবার নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘It hurts to be me’।

২০০৯ এর এক মধ্যদুপুরে তামাম দুনিয়ার অজস্র ভক্তের ভালবাসায় সিক্ত আর হাজারটা সমালোচনার তীরে বিদ্ধ জীবনটা শেষ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তা ছিল রহস্যময়তার চাদরে ঘেরা। সেই জীবনে দুঃখ ছিল, ব্যথা ছিল, রূপকথার মতো খ্যাতি ছিল আর ছিল এমন কিছু যাকে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেয়া যায় না।

বৈচিত্র্যময় এক জীবন পার করে দেয়া এই পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়েই আমাদের আজকের লেখা।

মাইকেলের বাবা জোসেফ জ্যাকসন আর দশটা স্বাভাবিক বাবার মতো ছিলেন না। অন্তত বাবা শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখে যে একজন স্নেহশীল  ‍পুরুষের ছবি ভেসে আসে, তেমন তো একেবারেই না। প্রয়োজনের চেয়েও বাড়াবাড়ি রকমের বেশি কঠোর ছিলেন জোসেফ।

জ্যাকসন আর তার চার ভাইকে নিয়ে গড়া ‘জ্যাকসন ফাইভ’ কে একটা ভালো জায়গায় দাঁড় করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন জ্যাকসন পরিবারের এই কর্তা। তবে তার অতিরিক্ত শাসনের অভ্যাসকে ছেলেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা বললে সেটা ঠিক হবে না। কারণ জোসেফ নিজের স্ত্রী অর্থাৎ মাইকেলের মা’র গায়েও নিয়মিত হাত  ‍তুলতেন। জ্যাকসন ভাইদের অবস্থা ছিল আরো বেগতিক। মাইকেলকে হাত দিয়ে ওপরে তুলে দেয়ালে ছুঁড়ে মারার মতো রেকর্ডও ছিল জোসেফের। নির্যাতন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, নিজের বাবাকে দেখামাত্রই মাইকেল জ্যাকসন বমি করতেন।

সেই শৈশবে বাবার প্রতি যে ঘৃণার জন্ম এটাকে মাইকেল প্রায় সারাজীবন পষেছেন। এই পপসম্রাটের জীবনের অনেক কিছুকে আকার দিয়েছে নিজের বাবার প্রতি এই ঘৃণা। কিছু গবেষকের মতে, শুধুমাত্র বাবা জোসেফের নাকের সাথে মিলে যায় বলে মাইকেল জ্যাকসন তাঁর নাকের আকৃতি পরিবর্তনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। শুধু নাকই না, গায়ের কাল রঙটাও বাবা জোসেফের মতো বলে সেটাকে ধবল বানানোর জন্য বারবার গিয়েছেন প্লাস্টিক সার্জনদের  ‍ছুরির নিচে। তবে নাকের আকৃতি বা চেহারায় অন্যান্য পরিবর্তন আনার এই যে চেষ্টা মাইকেল করে গেছেন জীবনভর এটার পেছনের ব্যাখ্যা শুধু বাবার ছায়া থেকে পালিয়ে বেড়ানোতে সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে রয়েছে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর ব্যাখ্যা।

গ্রিক পূরাণের চরিত্র আয়াকাসের কখনো বয়স বাড়ে না। আয়াকাস একজন বালক এবং সেটা চিরকালের জন্য। ধারণা করা হয় যে, মাইকেল মানসকিভাবে এই আয়াকাসের মতো। ১৩টি গ্র্যামি বিজয়ী এই গায়ক একজন চিরবালক। স্বাভাবিক শৈশব থেকে বঞ্চিত হওয়া মাইকেল শৈশবেই আটকে ছিলেন সারাজীবন। কিন্তু শরীর তো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে চলছিল। সেটাকে কৈশোরে এক পা দেওয়া বালকের মতো করতেই ১৩ বার প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন এই গায়ক, এমন ধারণা অনেক গবেষকের।

প্লাস্টিক সার্জারির প্রতি মাইকেলের এই অস্বাভাবিক মোহের পেছনের আরেকটা ব্যাখ্যাও আছে।স্বনির্ভরক্ষমতাবান নারীদের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল মাইকেলের। এলিজাবেথ টেইলরের মতো খ্যাতিমান অভিনেত্রীর সাথে মাইকেলের গভীর বন্ধুত্ব সেটা প্রমাণ করে। তবে প্রথম যে প্রভাবশালী নারীর সঙ্গে শৈশবে মাইকেলের খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তিনি হচ্ছেন ডায়ানা রস, সে সময়ের বেশ নামডাকঅলা গায়িকা। ধারণা করা হয় যে, মাইকেলের এত এত প্লাস্টিক সার্জারির একটা কারণ হতে পারে ডায়ানা রসের মতো হওয়ার চেষ্টা। সার্জারির পর মাইকেলের সাথে ডায়ানা রসের চেহারার সাদৃশ্য এই ধারণার পক্ষে বেশ শক্ত এক প্রমাণ।

পিটার প্যানকে আমরা মোটামুটি সবাই চিনি। ডিজনির চরিত্র পিটার প্যানের বয়স ১০ থেকে ১৩’র মধ্যে। প্যানের বয়স কখনো বাড়ে না। হুট করে পিটার প্যানকে টেনে আনার কারণ হলো মাইকেল নিজেকে পিটার প্যান হিসাবে দাবি করেছেন-একবার না, কয়েকবার। আগেও একবার বলা হয়েছে যে মাইকেল জ্যাকসন মানসিকভাবে বাল্যকালে আটকে ছিলেন জীবনভর। নিজেকে পিটার প্যানের মতো বালক দাবি করা এটার প্রমাণ দেয়।

নিজেকে পিটার প্যান দাবি করা ব্যাপারটার সাথে যৌনতা জড়িয়ে ছিল। মাইকেলের দ্বিতীয় স্ত্রী ডেব্বি রোয়ে একবার বলেছিলেন যে, যৌনমিলনের আগে মাইকেল পিটার প্যানের মতো বেশভূষা ধারণ করে কিছুক্ষণ নাচতেন। ডেব্বির মতে এই কাজটা মাইকেলকে যৌনমিলনের জন্য প্রস্তুত করত। তবে পিটার প্যান হবার এই অস্বাভাবিক চেষ্টার পেছনে মাইকেলের যৌনতা বিষয়ক অন্যান্য বিকৃতির সম্পর্ক আছে বলে ধারণা করা হয়। অন্যান্য বালক অথবা কিশোরের প্রতি মাইকেলের অস্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষার অভিযোগ আছে। নিজেকে বালক ভাবাটা মাইকেলের যৌনতাকে উদ্দীপিত করত, যেমন করত কৈশোরের আশেপাশে বিচরণ করা ছেলেরা।

পিটার প্যানে এতটাই  ‍বুঁদ ছিলেন জ্যাকসন যে একটা বিশাল প্রপার্টির নাম রেখেছিলেন পিটার প্যান গল্পের দ্বীপ ‘নেভারল্যান্ড’ এর নামে। রূপকথার মতো সাজানো এই নেভারল্যান্ড র‌্যাঞ্চেও এক ছেলে শিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ছিল মাইকেলের বিরুদ্ধে। অবশ্য মাইকেল সবসময়ই শিশু নিপীড়নের সব অভিযোগ অস্বীকার করে গেছেন। প্রত্যেকের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিকোণ ভিন্ন ভিন্ন। মাইকেলের কাছে শিশুদের নিপীড়ন কোনো অপরাধ ছিল না।

সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়া অ্যালবামের গায়ক মাইকেল জ্যাকসন তাঁর বিখ্যাত নাচের ভঙ্গি মুন ওয়াক এর মতোই জটিল মনস্তত্ত্বের অধিকারী ছিলেন। কয়েকশ পাতার গবেষণা হয়েছে শুধু মাইকেলের এর Narcissistic Personality Disorder এর ওপর।

অসুন্দর শৈশবকে তিনি জীবনভর দোষারপ করে গেছেন তাঁর ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ জীবনের জন্য। এককভাবে শৈশব দিয়ে মাইকেলের মনস্তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে পপরাজ্যের এই অধিপতির জীবন আমাদের আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় একটা সুন্দর শৈশব আর একটা সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ একজন মানুষের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কতটা জরুরি।

মাইকেল জ্যাকসনকে আমরা তাঁর কালজয়ী গান আর স্টেজ পারফমেন্সের জন্য মনে রাখব, নাকি মনে রাখব তাঁর জন্ম দেওয়া অসংখ্য বিতর্ক আর তাঁর অস্বাভাবিক দিকগুলোর জন্য-সেটা হয়তো ভবিষ্যতই ঠিক করে দেবে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

Previous articleওষুধ বাদ দিলে খুব খারাপ লাগে
Next articleশীতকালে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here