কৃতজ্ঞতাবোধ: একটি গুরুত্বপূর্ণ আবেগ

0
188
কৃতজ্ঞতা
আপনি জীবনে কোন জিনিষটির জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করেন? এই রকম মুহুর্তই বা ক’টা আসে জীবনে? অন্যকে ধন্যবাদ জানানো কি খুব সহজ? ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের নতুন জগতে এই রকম প্রশ্ন আজ খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ মানব সভ্যতার ইতিহাসে কৃতজ্ঞতার স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অন্তত আমাদের দেশে এটা এক ঘোর বাস্তব। উদাহরণ স্বরূপ, তামিল ভাষার রচনা “কুরাল”-এ এক হিন্দু কবি ও দার্শনিক আজ থেকে ১,২০০ বছর আগে দৈনন্দিন জীবনে কৃতজ্ঞতাবোধের গুরুত্ব নিয়ে উল্লেখ করেছেন। সেখান থেকেই একটা অংশ আমি উদ্ধৃত করছি, “একজন মানুষ চেষ্টা করলে তাঁর সমস্ত পাপ ধুয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু অকৃতজ্ঞতা মহাপাপ, যার থেকে আজ অবধি কেউ মুক্তি পায়নি।” (রিডিংস ফ্রম তিরুক্কুরাল, জি এন দাস, পৃঃ ৩২)

ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় কৃতজ্ঞতা ঠিক কী? ডাঃ রবার্ট এমন্স এই বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, “কৃতজ্ঞতা উপহার প্রাপ্তির পরের আবেগপ্রবন প্রতিক্রিয়া। কোন বিষয়ে উপকারিত হওয়ায় ব্যক্তির স্বীকৃতি আর সমাদরবোধ।”

উত্তর আমেরিকার হিন্দু মন্দির সমাজের সভাপতি এবং সমসাময়িক দার্শনিক ডাঃ উমা মাইসোরকারের মতে, “কৃতজ্ঞতা হিন্দু শাস্ত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। আমাদের সবসময় সব কিছুর জন্যে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ, কিন্তু কখনই অন্যের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা আশা করা উচিৎ না। নিঃস্বার্থ সেবাই আমাদের মূল ধর্ম।” শুধু হিন্দু ধর্মেই না, বিশ্বের সমস্ত ধর্মেই কৃতজ্ঞতাবোধের প্রয়োজন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিমী সভ্যতার ক্ষেত্রে গ্রিক দার্শনিক সিসেরো বলেছেন, “কৃতজ্ঞতাবোধ হল সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি।”
আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে, কিছুদিন আগে অবধিও মনোবিজ্ঞান জগতে এই মানসিকতাকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মার্কিনি দার্শনিক অ্যাব্রাহাম ম্যাস্‌লো এর ব্যাতিক্রম। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি উনি আত্ম-সিদ্ধি বিষয়ে নিজের গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন যে কর্মক্ষেত্রে সফল, সৃজনশীল এবং সন্তুষ্ট পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ এবং অভিব্যাক্তির মাত্রা অনেক বেশী যা মানসিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়। যাদের মধ্যে এর অভাব রয়েছে, তাঁদেরকে সঠিক পথ দেখানো জরুরী।  সেই জন্য তিনি এই বিষয়ে শেখানোর পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন, যেমন জীবনের খুশীর মুহূর্তগুলোর কথা বারবার মনে করা আর এতাও মনে রাখা যে আমাদের জীবন নশ্বর। ম্যাস্‌লো-র মতে প্রাচীন কথন “নিজের সৌভাগ্য মনে রাখা উচিৎ” আজও প্রাসঙ্গিক।

কৃতজ্ঞতাবোধের গুরুত্ব নিয়ে যে ক’জন আজ গবেষণা করছেন, তাঁদের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ রবার্ট এমন্সের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখেছেন যে, কৃতজ্ঞ ব্যক্তিরা মানসিক ভাবে অনেক বেশি সুস্থ হন। ফলে তাঁরা অনেক বেশি সুখী, ইতিবাচক, মিশুকে, এবং খোলা মনের অধিকারী হন। সহজ কথায় বলতে গেলে, কৃতজ্ঞতাবোধ আমাদের মনে ঈর্ষাকে জন্ম নিতে দেয় না।

শুধু কি তাই? বিভিন্ন সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যে সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে পারস্পরিক কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া খুব কমই হয়। কিন্তু সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আপনার সব থেকে কাছের মানুষটির প্রতি যদি আপনার কৃতজ্ঞতার মতো এক মজবুত এবং ইতিবাচক আবেগ প্রকাশ পায় তাহলে সেখানে রাগ বা হতাশার মত নেতিবাচক মনোভাব আসবে কোথা থেকে? উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ সারা এলগো এবং তাঁর সহকর্মীরা একটি বিশেষ গবেষণায় দেখেছেন যে, কৃতজ্ঞতাবোধ প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে ভীষণ রকম সাহায্য করে। বলাই বাহুল্য যে এই সামান্য প্রচেষ্টা, কোনও  বিলাসবহুল স্থানে ছুটি কাটানোর চেয়ে ঢের ভাল।

পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালেয়র ডাঃ মার্টিন সেলিগম্যান ও তাঁর সতীর্থরা মিলে কৃতজ্ঞতার সাহায্যে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তাঁর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন পদ্ধতিটি হল ‘কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পরিদর্শন’, যেখানে আপনি এমন কারও বাড়িতে দেখা করতে যাবেন যার প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ। তিনি আপনার শিক্ষক, বন্ধু, আত্মীয় বা যে কেউ হতে পারেন। শর্ত একটাই, তাকে জীবিত হতে হবে! তাকে আপনি নিজের হাতে একটি চিঠি দেবেন, যাতে আপনি নিজের কৃতজ্ঞতার কথা মন খুলে জানাবেন। এই পদ্ধতিটি যারাই অনুসরণ করেছেন তাঁরা হাতে নাতে এর সুফল ভোগ করছেন।

কার্যাবলী নির্দেশ
নিম্নলিখিত পাঁচটি উপায়ে আপনি আপনার জীবন আরও অনেক আনন্দময় করে তুলতে পারেন:

১) একটি তালিকা বানান। আগামী চার সপ্তাহে, সপ্তাহে একটি দিন বেছে নিন যেদিন আপনি জীবনে যে জিনিসগুলোর জন্যে কৃতজ্ঞ, সেই ব্যাপারে লিখবেন। এই লেখায় আপনার পরিবারের লোকজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, প্রতিবেশী, ইত্যাদি লোকের কথা ছাড়াও, নিজের স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা, ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ বা গুণাবলীর কথা উল্লেখ করতে পারেন।

২) একটি আলাদা খাতা বানান। প্রত্যেকদিন রাত্রে শোওয়ার আগে দিনের এমন একটি ঘটনার কথা লিখুন যার জন্যে আপনি কৃতজ্ঞ। সেটি কোনও তুচ্ছ সাধারণ ঘটনাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আজ যদি অফিসে জলদি পৌঁছে গিয়ে থাকেন বা পোস্ট-অফিসে কম ভিড় পেয়ে থাকেন,সেই ব্যাপারে লিখুন। আসল কথা হল নিয়মিত লেখা। এতে আপনার কৃতজ্ঞতাবোধ মজবুত হবে।

৩) নিজের কোনও আত্মীয় কে একটি কৃতজ্ঞতা-পত্র লিখুন। আপনি যদি বিবাহিত হন তাহলে নিজের জীবনসঙ্গীকে লিখুন। না হলে নিজের বাবা-মা অথবা ভাইবোনকেও লিখতে পারেন। আপনি সেই চিঠিতে সাম্প্রতিক কোনও ঘটনার উল্লেখ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, “আপনি গেল হপ্তায় আমায় যে কথাগুলি বলেছিলেন, তাতে আমার খুবই উপকার হয়েছে।”

৪) নিজের বন্ধুকেও একটি কৃতজ্ঞতা পত্র লিখুন।ঘনিষ্ট বন্ধুদের প্রতিও আমরা অনেক সময় ব্যস্ততার মাঝে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে যায়। মনে রাখবেন সবাই উপকারের স্বীকৃতি পেতে পছন্দ করেন। নিজের পছন্দ অনুযায়ী কোনও বন্ধুকে একটি হাতে লেখা চিঠি দিন, যাতে সুন্দর করে আপনার আবেগের কথা লেখা থাকবে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি নির্দিষ্ট কোনও ঘটনা উল্লেখ করেন।

৫) কৃতজ্ঞতাবোধ গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করুন। দেখা গেছে কোনও কিছু করার প্রতিজ্ঞা নিলে সেটা পালন করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বাড়িতে খুব সহজেই দেখা যায় এইরকম স্থানে আপনি সেই প্রতিজ্ঞার কথা লিখে রাখতে পারেন।

মূল লেখক: ডা. এডওয়ার্ড হফ্‌ম্যান, সহকারী অধ্যক্ষ, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ ইয়র্ক।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

Previous articleপুরুষ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন বেশি: গবেষণা
Next articleভয়কে জয় করে নতুন পৃথিবীর পথে যাত্রা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here