হ্যানস শেলি পুরো নাম হ্যানস হুগো ব্রুনো শেলি’কে বলা হয় Father of Stress । তিনি ১৯০৭ সালের ২৬ জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাঙ্গেরীতে বড় হয়েছেন এবং Hungarian Language University আজও তাঁর কীর্তি সগৌরবে বহন করছে।
১৯২৯ সালে শেলি প্যারাগুয়ে থেকে “ডক্টর ইন মেডিসিন” ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তিনি Rockefeller Foundation Scholarship পেয়ে চলে যান হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৬ সালে চলে আসেন ম্যাকগীল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে তিনি স্ট্রেস নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ১৯৪১ সালে শেলি সেখানে হিস্টোলজির প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৪৫ সালে শেলি Institute of Experimental Medicine and Surgery, Université de Montreal এর পরিচালক নিযুক্ত হন, যেখানে তাঁর প্রায় ৪০ জন সহকারী ছিল; যাদেরকে নিয়ে শেলি প্রায় ১৫০০০ প্রাণীর উপর গবেষণা পরিচালনা করেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭৯ সালে ডা. শেলি এবং অর্থার এনটিল যৌথ ভাবে Hans Selye Foundation এর কাজ শুরু করেন। পরবতীতে শেলি এবং আরো ৮ জন নোবেল বিজয়ী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন Canadian Institute of Stress । Kantha, ১৯৯২ সালে যেসব গবেষকদের কমপক্ষে ১০০০ গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের নিয়ে গবেষণা করেন। সেই গবেষণায় দেখা যায় যে ডা. শেলির প্রায় ১৭০০ গবেষণাপত্র, ১৫ টি মনোগ্রাফ এবং প্রায় ৩৯ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। শেলি বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনবার সম্মানসুচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া তিনি M.D., Ph.D., D.Sc. ডিগ্রীও অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রথমবার নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় দশবার নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। মহান এই মনীষী ১৯৮২ সালের ১৬ ই অক্টোবর কানাডাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্ট্রেস নিয়ে শেলির কাজঃ
ডাঃ হ্যানস শেলি স্ট্রেস (stress) ধারণাটির প্রর্বতক। স্ট্রেস এর একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা খুঁজে বের করার জন্য তিনি তাঁর সারা জীবন পাগলের মতো কাজ করে গেছেন। গ্রীক ভাষায় স্ট্রেসকে বোঝানোর জন্য একটা শব্দ ছিলো। এখন থেকে প্রায় ২৪ শত বছর পূর্বে হিপোক্রেটাস বলেছিলেন- রোগ বলতে শুধু ভোগান্তিকে বোঝায় না বরং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার জন্য কঠোর শ্রমকেও বোঝায়। এই ভোগান্তি ও দেহের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার জন্য কঠোর শ্রমকে গ্রীকরা নাম দিয়েছিল স্ট্রেস বা চাপ বা পীড়ন। এরপর জাপানীরা স্ট্রেস কে বোঝানোর জন্য তাদের নিজস্ব শব্দ তৈরি করে। যখন শেলি ফ্রান্সে যান স্ট্রেস নিয়ে কাজ করার জন্য তখন দেখতে পান যে ফরাসি ভাষায় স্ট্রেসকে বোঝানোর জন্য কোন শব্দই নেই। তখন ফরাসি ভাষায় স্ট্রেসকে বোঝানোর জন্য Le stress বাছাই করা হয়। একই ঘটনা ঘটে শেলি যখন জামার্নীতে যান স্ট্রেস নিয়ে বক্তৃতা প্রদানের জন্য। তখন জার্মান ভাষায় স্ট্রেসকে বোঝানোর জন্য Der stress শব্দটিকে বাছাই করা হয়। যেহেতু এটা পরিষ্কার ছিল যে অধিকাংশ মানুষ স্ট্রেসকে অস্বস্তিকর বিষয় হিসেবে দেখে তাই তিনি উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নতুন একটা শব্দ তৈরি করেন “stressor” । ১৯৫১ সালে স্ট্রেস এর উপর বার্ষিক রিপোর্ট তৈরি করার সময় শেলি উল্লেখ করেন যে স্ট্রেস নিজেই নিজের কারণ এবং ফলাফল।
১৯২৬ সালে শেলি যখন মেডিকেলের ২য় বর্ষের ছাত্র, তখন থেকেই তিনি স্ট্রেস নিয়ে তত্ত্ব বিকাশের কাজ শুরু করেন। তিনি তাঁর তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে রোগ ও ইনজুরির চাপের প্রতি মানুষের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার উপর স্ট্রেসের কী প্রভাব রয়েছে। তিনি দেখেছিলেন যে বিভিন্ন রোগে রোগীরা প্রায় একই ধরনের লক্ষণ প্রকাশ করে। এটাই ছিল স্ট্রেসকে বোঝার জন্য তাঁর প্রথম পদক্ষেপ। তিনি পরবর্তীতে General Adaptation Syndrome (GAS) তত্ত্ব প্রকাশ করেন যেটা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির উপর করা একটি পরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়। তখন তিনি ভেবেছিলেন হয়তো তিনি নতুন এক প্রকার হরমোন খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখন যখন তিনি বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে একই ধরনের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলেন। বিভিন্ন রোগে মানুষ প্রায় একই ধরনের লক্ষণ প্রকাশ করে, আগে প্রাপ্ত এই ধারণার সাথে তিনি বর্তমানের পরীক্ষণের ফলাফলের মিল খুঁজে পান এবং এখান থেকেই এক ধরনের ক্ষতিকর দ্রব্যের প্রভাব বর্ণনা করেন। পরবর্তীতে তিনি এর নাম দেন “stress” ।
GAS হলো আমাদের শরীরের উপর আরোপিত বিভিন্ন চাহিদা বা চাপের প্রতি আমাদের শরীরের একধরনের প্রতিক্রিয়া। কিভাবে স্ট্রেস স্বয়ংক্রিয়ভাবে হরমোনাল প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং সময়ের ব্যবধানে এই স্ট্রেস কিভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ (যেমনঃ আলসার, উচ্চরক্তচাপ, বাতের ব্যথা, কিডনীর রোগ, এলার্জী ইত্যাদি) তৈরি করে তা এই GAS মডেল বর্ণনা করে। শেলি তাঁর এই স্ট্রেস নিয়ে কাজ করার জন্য Claude Bernard এবং Walter Canon এর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। শেলি স্ট্রেসের দুটি উপাদানের কথা বলেছেন, একগুচ্ছ প্রতিক্রিয়া যাকে তিনি বলেছেন এক, GAS এবং দুই, স্ট্রেস থেকে রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া।
শেলির মতে, স্ট্রেস অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া থেকে আলাদা এই অর্থে যে, স্ট্রেস খুব বেশি চাপ সৃষ্টিকারী সে আমাদের সাথে ভালো বা খারাপ যা-ই ঘটুক না কেন! এজন্য তিনি স্ট্রেসকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। ঋণাত্বক স্ট্রেসকে বলেছেন Distress এবং ধনাত্বক স্ট্রেস কে বলেছেন Eustress । আমাদের শরীর যে তন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেসকে মানিয়ে নেয় তার নাম হল HPA axis বা হাইপোথ্যালামিক পিটুইটারি এড্রিনাল এক্সিস, এটিও শেলি আবিষ্কার করেন। তিনি তাঁর GAS মডেলে তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছেন। প্রথম পর্যায়ের নাম হলো Alarm Reaction stage, যেখানে আমাদের শরীর কোন stressor এর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হয়। দ্বিতীয় পর্যায় হলো Resistence Stage, যেখানে আমাদের শরীর ক্রমাগতভাবে কোন stressor কে মোকাবেলা করে যায়। তৃতীয় পর্যায় হলো Stage of Exhaustion, যেখানে আমাদের শরীর বিদ্যমান stressor কে মোকাবেলা করতে পারে না, তখন আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।
শেলি তাঁর জীবনে স্ট্রেস নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলঃ The Stress of Life (1956), From Dream to Discovery: On Being a Scientist (1964) এবং Stress without Distress (1974) । শেলি ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন International Institute of Stress. শেলির এই বহুমুখী কাজ, গবেষণা এবং ধারণাগুলো বর্তমানে মেডিসিন সহ প্রায় সকল Biological Discipline এ ব্যবহার করা হচ্ছে।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে