ডা. মো. আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মানসিক রোগ বিভাগ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, রংপুর।
আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরুর কথাটি কি মনে আছে? বিশ একুশ বছর আগের কথা। আমরা মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় কি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তখন হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখেছি। নকিয়া বাটন ফোন, দামও বেশ চড়া। ধনী লোক ছাড়া কারও পক্ষে তা কেনা সহজ ছিল না। এক মিনিট কথা বলতে দশ টাকা খরচ হতো।
ইন্টারনেটও ছিল তখন নাগালের বাইরে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও ডেক্সের ব্যবহার তখন সেই অর্থে শুরুই হয়নি। তখন মানুষের তথ্য জানার সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম ছিল বই পড়ে জানা, রেডিও, টিভি ও খবরের কাগজ পড়ে জানা অথবা শিক্ষক বা জ্ঞানী মানুষের নিকট হতে জেনে নেওয়া। বই পড়ার ক্ষেত্রে আবার রেফারেন্স বুক ছাড়া অন্য কোনো বাজারে নোট বা চটি বইয়ের তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তথ্য প্রযুক্তিখাতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে।
রেডিও, টিভি, বাটন ফোনের জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে নেয় কালার টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি ডিভাইসগুলো। এর সাথে যোগ হয় ইন্টারনেট সেবা। সেলুলার ফোনে ইন্টারনেটের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি ওয়াইফাই ইন্টারনেট সার্ভিসের ব্যবহার মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। মানুষ এখন আর বই পড়ে, টিভি দেখে, খবরের কাগজ পড়ে বা জ্ঞানী মানুষের পিছনে ঘুরে জ্ঞান অন্বেষণ করতে চায় না। এখন সবকিছুর সমাধান যেন সোশ্যাল মিডিয়া।
কোনো কিছুর দরকার হলেই গুগল সার্চ, ইউটিউব দেখে অথবা কোনো পেজ, গ্রুপ বা ফেসবুকে কে, কী পোস্ট করল তা দেখেই যেন সব জানার চেষ্টা। প্রাপ্ত তথ্য সঠিক বা ভুল তা যাচাই-বাছাই না করেই সবটুকু আমরা বিশ্বাস করে ফেলছি। ফলে অনেক সময়ই আমরা ভুল জেনে ভুলের পিছনে ছুটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য কীভাবে ক্ষতি করে
বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের হার অনেক বেড়ে গেছে বিগত দশকে। বেড়েছে তথাকথিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ইউটিউবারের সংখ্যা। এরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর কন্টেন্ট নির্মাণ করে তাদের পেজে ও ইউটিউবে আপলোড করে। এগুলো যত মানুষ দেখে, লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করে তার উপর ভিত্তি করে তারা মনিটাইজেশনের মাধ্যমে টাকা পায়।
এগুলোকে অনেকে এখন তাদের উপার্জনের মূল পেশায় পরিণত করেছে। অনেকে তথ্য-উপাত্ত ভালো করে বিশ্লেষণ না করে বা বই-পুস্তক না পড়েই অর্ধসত্য, মিথ্যার সমন্বয়ে বা অনির্ভরশীল কোনো সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে অথবা অন্য কারও পোস্ট করা তথ্য চুরি করে কন্টেন্ট নির্মাণ করছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এগুলো দেখেই যারা যাচাই বাছাই না করে বিশ্বাস করছে, তারা ভুল জেনে নিজেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি এসব ভুল তথ্য ছড়িয়ে জাতি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করছে। ভুল তথ্য বা গুজব ছড়ানোর কারণে সঠিক বিষয়টাই অনেক সময় মানুষের জানার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিছু মানুষ আবার গুগল ও ইউটিউব ঘেটে অনেক কিছু জানার চেষ্টা করে।
এখানেও যদি সংগৃহীত তথ্যের উৎস বা জার্নাল সাইট নির্ভরযোগ্য বা অথেনটিক না-হয় তাহলে বিপদ। কারণ সকল জায়গাতেই অসাধু চক্র তৎপর আছে। রিসার্চ বা গবেষণার ক্ষেত্রেও অনেক সময় কেউ কেউ সঠিকভাবে ডেটা সংগ্রহ না করেই অনুমান নির্ভর তথ্য উপাত্ত দিয়ে থিসিস ওয়ার্ক করে জার্নালে পাবলিশ করছে। অনুমাননির্ভর এসব থিসিসের তথ্যওসমানভাবে ক্ষতিকর।
কারণ অনুমান নির্ভর ফলাফল সঠিকভাবে সম্পাদনকৃত থিসিসের ফলাফলকে বিভ্রান্ত করতে পারে বা প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। অর্থাৎ জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল তা নিরূপণ করতে গিয়ে। তখন কোনোটাই আর তারা বিশ্বাস করতে চাইবে না।
অন্যদিকে কোনো বিষয়ের উপর আংশিক জ্ঞান বা সম্পূর্ণ জ্ঞানের অভাবও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে। যেমন, প্যারাসিটামল ওষুধের অনেকগুলো ব্যবহার থাকলেও অনেকে জানে এটা শুধুমাত্র জ্বরের ওষুধ। ডাক্তার যদি অল্প ব্যথায় এই ওষুধ প্রয়োগ করেন তাহলে না জানার কারণে ব্যক্তি বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং ডাক্তারকে দোষারোপ করতে পারেন।
একটি রোগ হওয়ার কারণ, উপসর্গ,রোগের ঝুঁকি, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা, চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধের প্রয়োগ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, রিস্ক-বেনিফিট রেসিও, অপারেশন পদ্ধতি, অপারেশন পরবর্তী জটিলতা ইত্যাদির সবকিছুই একজন চিকিৎসককে ভালোমতো রপ্ত করতে হয়। তাই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অল্প বিস্তর জেনে বা ভুল তথ্য জেনে সেটা প্রচার করলে জনগণের মধ্যে যেমন অসন্তোষ তৈরি হয়, তেমনি পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
শুধুমাত্র চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয়, গুজব বা অপপ্রচার সকল ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে অস্থিরতার জন্ম দেয়, জনগণের জান-মালের ক্ষতি করে, উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। ভুল তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে মানুষকে উসকে দিয়ে নানারকম অপতৎপরতায় লিপ্ত করা, মারামারি, জ্বালাও-পোড়াও করার উদাহরণ নেহায়েত কম তো নেই। কথায় বলে, গুজব রটে বেশি বা খারাপ কথা বাতাসের আগে চলে।
সঠিক তথ্য সংগ্রহে করণীয়
- জ্ঞান অন্বেষণের পিছনে মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা আজন্ম। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করতে জ্ঞান অন্বেষণের কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই আহরিত জ্ঞান হতে হবে পরিশীলিত, সঠিক ও বাস্তব তথ্যনির্ভর। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুল তথ্য হতে মুক্ত থাকার উপায় সমূহ-
- যেকোনো বিষয়ের ওপর তথ্য জানতে হলে অবশ্যই তা রেফারেন্স সোর্স বা অথেনটিক সোর্স থেকে জানতে হবে।
- সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো তথ্য বিশ্বাস করা, প্রচার করা ও কমেন্ট করার আগে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য উৎস হতে যাচাই-বাছাই করে এর সত্যতা নিশ্চিত হতে হবে।
- অযথা কৌতূহলবশত বা কাউকে উসকে দিতে বা কারও ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি কারও উপকার করতে না পারেন, অন্তত ক্ষতির কারণ হবেন না।
- কোনো কন্টেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ইউটিউবারদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। শুধুমাত্র উপার্জনের উদ্দেশ্য যেনতেনভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য সম্বলিত কন্টেন্ট নির্মাণ হতে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে সময় নিয়ে সঠিক তথ্য জেনে বা প্রাপ্ত তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করে সত্যতা নিরূপিত হলেই তা পরিবেশন করবে।
- চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারেও সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে হবে। না হলে উক্ত বিষয়ের উপর বিশেষ জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তি বা চিকিৎসকের সাথে কথা বলে আসল বিষয়টি জানার চেষ্টা করতে হবে।
- শুধু জনগণের উপর সব দোষ দিয়ে দায় এড়ানো চলবে না। চিকিৎসকসহ সমাজের সচেতন ব্যক্তিদেরও সঠিক বিষয় প্রচারে ও জনসাধারণকে সচেতন করতে বেশি বেশি তৎপর হতে হবে।
- চিকিৎসককে রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। তাড়াহুড়ো করে যেনতেনভাবে চিকিৎসা করা যাবে না। জটিল রোগের চিকিৎসা, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা, ওষুধের প্রয়োগ, ক্ষতিকর প্রভাব ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, প্রয়োজনীয় পরামর্শ সবকিছু নিয়ে রোগী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে হবে। প্রয়োজনে রোগী ও অভিভাবকদের পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং করতে হবে।
- কোনো নিউজ পরিবেশন করার আগে সংবাদ মিডিয়াগুলোকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জনমনে কোনো ভুল নিউজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পুরো সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা তা ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে।
- গুজব রটানো ও অপপ্রচারকারীকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
- জনগণকে বলতে চাই-কোনো কিছুতে অযথা অস্থির হবেন না। সময় নিয়ে ভাববেন আপনি যা জেনেছেন তা কতটুকু সত্য বা মিথ্যা। যদি সত্যিই অন্যায়ের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নিন।
পরিশেষে বলতে চাই, তথ্যের অবাধ প্রবাহ যেমন থাকতে হবে, তেমনি তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রেও সচেতন থাকতে হবে। তথ্য জানার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। হুজুগে বা গুজবে কান না দিয়ে নিজের বিবেককে জাগ্রত রাখবেন। কোনো কিছু বিশ্বাস করার আগে যাচাই বাছাই করে তা বিশ্বাস করবেন। তাহলেই ভুল তথ্যের অস্থিরতা জনগণের মুক্তি মিলবে।
আরও পড়ুনঃ