দু’চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা ঘর বাধিঁ। থাকে ভালোবাসার আর প্রত্যাশার দোলা। আমরা সবাই গড়ে তুলতে চাই সুন্দর, শান্তির আর ভালবাসার একটি নীড়। বেশীর ভাগক্ষেত্রেই এই প্রত্যাশা বাস্তব রূপ পায় না। অনেক সংসারেই দেখা দেয় শান্তি আর ভালোবাসার অভাব। কখনও বিবাহিত জীবনের প্রথম থেকেই আরম্ভ হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন আবার কখনও ভালবাসার অভাব বোধ হয় পথ চলার কোনো মোড় থেকে। বিবাহিত জীবনের নেতিবাচক পরিণতি আমাদের কারোরই কাম্য নয়। তাই চলুন এমন কিছু বিষয় জেনে নেই যা আমাদের বিবাহিত জীবনের দৃঢ় ভিত রচনায় যথেষ্ট সহায়ক।
ভালোবাসাকে যদি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তবে এতে থাকে বেশ কয়েকটি উপাদান যেমন- পারস্পরিক বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সেবার মনোভাব, শারীরিক আকর্ষণ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও একজন আরেকজনকে বুঝতে পারা, তাই স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে এই উপাদানগুলোর বিকাশ ঘটানো ও তা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।
কোনো বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর সাথে সাথে বেশ কয়েকটি বন্ধন তৈরি হয় যেমন- সামাজিক বন্ধন, ধর্মীয় ও আইনগত বন্ধন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বন্ধন তৈরি হয় না তা হল মানসিক বন্ধন। এই মানসিক বন্ধন তৈরি হতে সময় লাগে এবং তা গড়ে তুলতে হয় অত্যন্ত যত্নের মাধ্যমে। বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে ধৈর্য্য ও যত্নের সাথে মানসিক বন্ধন গড়ে তুললে তা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দৃঢ় ও ভালবাসার সম্পর্ক সৃষ্টিতে অত্যন্ত সহায়ক হয়।
বিয়ের পর অনেক স্বামী মনে করেন তার স্ত্রী যেন পুরোপুরিভাবে তার নিজের পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে যান। অর্থাৎ তার পরিবারের সংস্কৃতি পুরোপুরিভাবে ধারণ করেন। আবার উল্টোটাও দেখা যায় অর্থাৎ স্ত্রী চান স্বামী যেন স্ত্রীর পরিবারের সংস্কৃতিতে নিজেকে ঢেলে সাজান। এই ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকটি হল যে পুরোপুরিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে (স্বামী বা স্ত্রী যেই হোক) তার নিজস্ব পরিচিতি (identity) ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য (individuality) বজায় থাকছে না। ফলে তার মধ্যে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়। এই সংকটের কারনে সে মানসিকভাবে চাপের মধ্যে থাকে, আনন্দ পায় না এবং অসুখী হয়। মা-বাবা হিসাবেও সে সঠিকভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তাই প্রত্যাশিত ব্যবস্থা হল স্বামী-স্ত্রী দুজনই একে অপরের পরিবারের সংস্কৃতি ধারণ করার চেষ্টা করবে এবং ততটুকুই পরিবর্তিত হবে যা পরিচিতির সংকট ঘটাবে না। দুজনই কিছুটা সরে এসে একটা নতুন পরিবারের সংস্কৃতি গড়ে তুলবে যা হবে দুজনের পরিবারের সংস্কৃতির মিলন।
পরিবারের নানা ধরনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো পরিবারে বিয়ের পর স্ত্রীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে দেওয়া হয় না এতে স্ত্রী অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এই অবস্থায় স্ত্রী নিজেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন এবং পরিবারের দায়িত্ব নেবার ব্যাপারে আগ্রহী হন না। এছাড়া এই ব্যবস্থা তার সিদ্ধান্ত নেবার দক্ষতাকে বিকশিত করে না। স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সব বিষয়ে উভয়কেই অংশ নিতে হবে।
স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় ও সুন্দর করার আরেকটি দিক হল বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করা। আলোচনার বিষয় হতে পারে নানা-রকম যেমন সংসারের কথা, অফিসের বিষয়, টেলিভিশনে দেখা কোনো অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বিষয়, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় ইত্যাদি। আলাপ-আলোচনা একজনকে আরেকজনের কাছে আসতে সাহায্য করে।
স্ত্রী বা স্বামী একজন আরেকজনের মন ভালো রাখার জন্য ও আত্ম-বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য পরস্পর পরস্পরকে প্রশংসা করা খুবই জরুরি। সংসারে একটা প্রশংসার সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরস্পর পরস্পরকে নানা কাজের জন্য প্রশংসা করতে পারেন। যেমন-রান্নার কাজ, ঘুর গুছানো, সৃজনশীল কোনো কাজ, বাজার করার কাজ, মেহমানদারী করা, শিশু লালন-পালনের কাজ, পরিপাটি হয়ে থাকার কাজ ইত্যাদি। প্রশংসা শুনলে আমাদের মন ভাল হয়, যে কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছি তা বার বার করার ইচ্ছা জাগে এবং আত্ম-বিশ্বাস বেড়ে যায়।
(চলবে)
ফরিদা আকতার
মনোবিজ্ঞানী
এ সম্পর্কিত অন্য লেখার লিংক-
সুখী হোন বিবাহিত জীবনে: দাম্পত্য সম্পর্কে সহিংসতা ও শান্তি
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।