শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গঠনোপযোগী পরিবেশ

0
146
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গঠনোপযোগী পরিবেশ, ছবিঃ ইউনিসেফ

শিশুকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য শরীরিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যেরও বিকাশ প্রয়োজন। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য গঠনের জন্য পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে এরিকসন, ফ্রয়েড, অ্যাডলার প্রমুখ শিশুর প্রথম কয়েক বছরকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার উপায়। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার উপায় হলো-

স্বাস্থ্যকর গৃহ পরিবেশ

স্বাস্থ্যকর গৃহ পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে হবে বা সচেতন হতে হবে তা হলো-

স্বাস্থ্যকর স্থানে বাসস্থান নির্বাচন: বাসস্থানটি হবে এমন এলাকায় যেখানে আলো বাতাসে পরিপূর্ণ থাকবে। কলকারখানা, বাজার, রেল ষ্টেশন, হাসপাতাল ইত্যাদি শিশুর মনকে অস্থির করে তোলে এবং গৃহের পরিবেশের ক্ষতি করে পরিবেশ দূষণ ঘটায়। তাই শিশুকে যত্নের সাথে গড়ে তুলতে হলে স্বাস্থ্যকর আবাসিক এলাকায় বাসগৃহের স্থান নির্বাচন করতে হবে।

স্বাস্থ্যকর মানসিক পরিবেশ: শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। শিশুর মন থাকে সাদা কাগজের মত। সে যা দেখে তাই অনুকরণ করে। তাই শিশুকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হলে একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দরকার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সহনশীলতার সম্পর্ক থাকতে হবে। বাসগৃহ হবে সুশৃঙ্খল ও শান্তির নীড়। গৃহের সুন্দর সুস্থ পরিবেশ শিশুর মানসিক বিকাশে সাহায্য করে।

মা-বাবার স্বাস্থ্যকর দাম্পত্য জীবন

দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা সুষ্ঠুপরিবেশেই বিকশিত হয়। বাবা-মায়ের মধ্যে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালোবাসাপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক গৃহ পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ করে। ফলে শিশুনিরাপত্তা বোধ করে ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, মৃত্যু, অপরাধ প্রবণতা শিশুর সার্বিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে শিশুনানা প্রকার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের আচরণে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।

শিশুর প্রতি পিতা-মাতার আসক্তি

শিশুর মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি অন্যান্য চাহিদা পূরণের মধ্যে দিয়ে শিশু ও পিতামাতার মধ্যে আসক্তি সৃষ্টি হয়, যেমন- স্পর্শ করা, শিশুকে কোলে নেওয়া, আদর স্নেহ করা, খাওয়ানো ইত্যাদির মাধ্যমে শিশু ও পিতা মাতার মধ্যে আসক্তির সৃষ্টি হয়। শিশুপিতামাতার আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে এবং তাদেরকে আপন মনে করে। মা বাবার স্নেহ-মমতাপূর্ণ ভালোবাসা ও মৌলিক চাহিদার পরিতৃপ্তি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় সহায়তা করে।

শাসন পরিচালনা

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে পিতামাতার শাসন পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শিশুবড় হওয়ার সাথে সাথে তার মধ্যে ব্যক্তিত্ববোধ জাগ্রত হয়। পিতামাতা শিশুর মধ্যে অর্থপূর্ণ আচরণ, শৃংখলা বোধ এবং মূল্যেবোধ বিকাশের জন্য নানা ধরনের পরিচালনা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। পিতামাতার অতিরক্ষণশীল আচরণ শিশুর স্বাধীন আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তি দমন করে। শিশুপিতামাতার উপর নির্ভরশীল হয়। সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। পরনির্ভরশীল হওয়া, শিশুর আগ্রহ, ইচ্ছা বা অনিচ্ছার প্রতি পিতা-মাতার অতিমাত্রায় স্বীকৃতিসূচক মনোভাব শিশুকে স্বার্থপর, জেদি, দায়িত্বহীন ও অবাধ্য করে তোলে। তেমনিভাবে শিশুর প্রতি পিতামাতার অবহেলা, উদাসীনতা ও প্রত্যাখ্যান শিশুকে নিরাপত্তাহীন, আস্থাহীন ও অসহায় করে তোলে। শিশুকে সবসময় শাসন করলে, বাধা নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে শিশুর মনে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় যা তাকে অসামাজিক কাজে লিপ্ত করে। অতিরিক্ত শাসন ও নেতিবাচক আচরণ শিশুর মনের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে, তার মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হয়। শিশুপরিচালনায় শিশুকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত যাতে শিশুনিজের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে শেখে। শিশুকে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণ

শিশুকতগুলো মৌলিক চাহিদা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যেমন- দৈহিক চাহিদা: খাদ্য, পানি, আবাসস্থল, আলো-বাতাস, নিদ্রা, মলমূত্র নিঃসরণ ইত্যাদি; মানসিক চাহিদা: নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, স্বীকৃতি, অধিকার বোধ, স্নেহ-ভালোবাসা, আত্মপরিচিতি ইত্যাদি চাহিদাগুলোর তৃপ্তিকর অনুভূতি মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজন।

বয়ঃসন্ধিকালে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি

বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেমেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। এ সময় তারা মা বাবার চেয়ে বন্ধু বান্ধবের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়। তাই মা-বাবা ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাদেরকে ভালো ও মন্দের দিক নির্দেশনা দিতে হবে। সতর্ক করতে হবে যাতে তারা বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক ও সচেতন হয়। বাবা মায়ের প্রতি যাতে তারা আস্থাশীল হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক

শিক্ষকের আচরণ ও পাঠ্যক্রম শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিদ্যালয়ের বিশৃংখল পরিবেশ, কঠিন পাঠ্যক্রম, শ্রেণিকক্ষে কঠোর শাস্তি প্রদান শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ণ করে। একজন শিক্ষক সহজেই নিঃসংগ ও আত্মবিশ্বাসহীন শিশুকে সহযোগিতা করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে যাতে সে পরবর্তীকালে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সবার সাথে সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। সুতরাং পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিশুর বিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন বাধার প্রতি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিশুর মানসিক সুস্বাস্থ্য রক্ষায় পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে। শিশুর নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব। শিশু নির্যাতন সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে হবে। শিশুরাই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই তাদের জন্য সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শরীর ও মন যেহেতু ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, তাই শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য নয় মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নেও সকলের সচেতনতা আবশ্যক।

সুত্রঃ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র, ইউনিট ৭ পৃষ্ঠা ১০০।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleহাসান আজিজুল হক আজীবনের স্বাপ্নিক
Next articleসায়েন্টিফিক কনফারেন্সে দুই ক্যাটেগরিতে অ্যাওয়ার্ড দেবে বিএপি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here