শিশুর খেলনা: চাহিদা বুঝে দিতে হবে

0
318

শিশুর বিকাশে যেমন খেলাধুলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি খেলনার সামগ্রীরও আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। খেলাধুলার মাধ্যমেই শিশু বয়সে বাচ্চাদের নিজেদের আইডেন্টিটি বা পরিচয় গড়ে ওঠে। শিশুরা অনবরত চারপাশের পরিবেশ থেকে শিখতে থাকে। এই শেখার মধ্য দিয়ে তাদের মনের বিকাশ হতে থাকে। যে বিকাশে খেলনা সামগ্রী সরাসরি ভূমিকা রাখে। শিশু বয়সে শুধুমাত্র খেলতে খেলতেই বাচ্চারা এমন অনেক দক্ষতা অর্জন করে যেগুলো সারা জীবনভর কাজে লাগে। খেলতে খেলতে তারা সামনে আসা কোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে শেখে, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে শেখে, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীলতা ও কল্পনা করার দক্ষতা তৈরি হয়। উপযুক্ত খেলনা সামগ্রী এসব দক্ষতা অর্জন আর বিকাশ ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে।

কিন্তু এই উপযুক্ত খেলনা সামগ্রী বলতে আসলে কী বোঝায়? কিংবা একজন শিশুর আসলে কতগুলো খেলনার প্রয়োজন?

কানাডিয়ান চাইল্ড ক্লিনিক্যাল কাউন্সেলর ডেবোরাহ ম্যাকনামারা বলছেন, এতে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই যে শিশুদেরকে খেলতে দিতে হবে। কিন্তু সবসময় যে খেলার জন্য বাজার থেকে কিনে আনা খেলনাই দিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বাচ্চাদের অনুসন্ধানী মন আশেপাশের যেকোনো বস্তুর মাঝেই খেলার উপাদান খুঁজে পায়। ওরা মূলত ওদের চারপাশের পরিবেশটাকে অনবরত আবিষ্কার করতে থাকে। সুতরাং আমাদের ঘরের মধ্যেই থালা-বাসন থেকে শুরু করে বাক্স-পেটরা মিলিয়ে যথেষ্ট উপাদান আছে শিশুদের খেলার মতো।

শিশুরা বড়ো হতে থাকলে তাদের খেলার ধরন ও খেলনার চাহিদারও পরিবর্তন হতে থাকে। শিশুরা বেশির ভাগ সময় তাদের অভিভাবকদের সান্যিধ্যেই কাটায়। এর বাইরে যতটুকু সময় তারা নিজেদের সঙ্গে থাকে, হাত ও মুখ ব্যবহার করে চারপাশের নানা ধরনের বস্তুকে বুঝতে চায়, চিনতে চায়। এই সময়ে শিশুদেরকে এমন কিছু দেয়া উচিৎ যেগুলো তাদের কল্পনাশক্তি তৈরিতে সাহায্য করবে। তাদের হাতে নানা ধরনের বস্তু খেলনা হিসেবে দেয়া উচিৎ। বাড়ির থালাবাসন থেকে শুরু করে লেগো ব্লক, পুতুল বা খেলনা পশু-পাখি যেকোনো কিছু হতে পারে।

বাচ্চাদেরকে ঠিক কতগুলো খেলনা দেয়া উচিৎ এটার কোনো নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা নাই। তবে একদল আমেরিকান গবেষকদের গবেষণায় পাওয়া গেছে, খেলনার পরিমাণ কম হলে শিশুরা প্রতিটি খেলনা নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে বেশ অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত করে এবং তাদের খেলার ধরনে অনেক সৃজনশীল কর্মকান্ড দেখতে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে খেলনার পরিমাণের চেয়ে খেলনাগুলোর সঙ্গে শিশু কতটা একাত্মতা অনুভব করছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুদের খেলনার চাহিদা বোঝার জন্য তাদের পছন্দের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। শিশুরা যখন চার-পাঁচ বছর বয়সের দিকে যায়, তখন তারা প্রত্যেকে নির্দিষ্ট ধরনের খেলা বা খেলনার প্রতি আগ্রহ দেখায়। কেউ লেগো ব্লক বা এটা-ওটা দিয়ে বাড়ি-ঘর বানায়, কেউ ট্রেন বা গাড়ির প্রতি আগ্রহ দেখায়, কেউ পুতুলদেরকে অ্যাডভেঞ্চারে নিয়ে যায় বা খাবার খাওয়ায়। অভিভাবকদের বাচ্চাদের এইসব আগ্রহের প্রতি নজর দেয়া দরকার এবং তাদের আগ্রহ অনুযায়ী খেলনা সামগ্রী সরবরাহ করা উচিৎ। তবে অবশ্যই খেলনা সামগ্রীর সঙ্গে কল্পনাশক্তি বিকশিত করার যথেষ্ট সুযোগ রাখতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে বাচ্চাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে ওরা কীভাবে খেলবে সেটা নির্ধারণে। প্রাপ্তবয়স্করা যখন নিজেদের মতো করে বাচ্চাদের খেলা পরিচালনা করতে চান, যখন কোনো একটা খেলনাকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মেই ব্যবহার করতে চান, বাচ্চাদেরকে নিজেদের কল্পনার জগতে ছেড়ে দেন না তখন শিশুদের জন্য সেটা আর খেলা থাকে না। তাদের বিকাশও যথাযথভাবে হয় না। শিশুরা আরেকটু বড়ো হয়ে নিজেদের চাহিদা প্রকাশ করবে। নিজের পছন্দমতো খেলনার আবদার করবে। তাদের এসব আবদার অভিভাবকরা যতটা সম্ভব পূরণ করবেন। সেইসঙ্গে এটাও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, শিশুদের জন্য সেই সব অ্যাক্টিভিটি বা খেলা বা কার্যক্রম সবচেয়ে কার্যকর যেখানে সে নতুন নতুন পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সুতরাং খেলনার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদেরকে কোনো জাদুঘর বা বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়াও খেলাধুলারই একটি অংশ।

শিশুদের জন্য সবচেয়ে আদর্শ খেলনা সামগ্রী হতে পারে ছবি আঁকার সরঞ্জামাদি। দুই বছর বয়স থেকে পুরো শিশুকালই তাদের আঁকতে দেয়া উচিৎ। আঁকা-আঁকির মধ্য দিয়ে যেমন ওদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়, তেমনি বিমূর্ত চিন্তা ক্ষমতারও বিকাশ হয়। শিশুরা যেভাবে অন্যের আচরণ দেখে শেখে, তেমনি ছবি আঁকতে গিয়ে নানান আকার ও আকৃতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা তৈরি হয়। তাছাড়া ছবি আঁকার ফলে শিশুদের সৃজনশীলতা, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের জন্য অভিভাবকেরা সহজেই তাদের প্রশংসা করতে পারেন। এই প্রশংসা শিশুর মানসিক বিকাশ ও আত্মবিশ্বাস গঠনের জন্য ভীষণ প্রয়োজন এবং ছবি আঁকার কারণে বাচ্চাদেরকে বাস্তব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা দেয়া যায়। সবকিছু সবসময় পারফেক্ট বা নিখতুঁ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।

সুতরাং যদিও মনে হতে পারে তুলনামূলক কম খেলনা সামগ্রী শিশুর জন্য ভালো কিন্তু শিশুর চারপাশ অনেক বেশি খেলনা দিয়ে ভরে গেলেও আসলে চিন্তার কিছু নেই। তারচেয়ে বেশি যেটা জরুরি সেটা হলো খেলনার বৈচিত্র্য। খেলনা দিয়ে শিশুকে স্বাধীনভাবে খেলতে দেয়া এবং শুধু খেলনার প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে শিশুর সঙ্গে মানবিক যোগাযোগমূলক খেলাধুলাও করা, খেলনার বাইরেও শিশুকে সময় দেয়া, তার সঙ্গে কথা বলা, তাকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া।

তথ্যসূত্র:

https://www.sciencedirect.com/science/article/abs/pii/S0163638317301613https://www.todaysparent.com/family/parenting/how-many-toys-do-kids-really-need

ফিরোজ শরীফ

মনোবিদ।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।   

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে  

 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleশুধুমাত্র শিশু নয় অভিভাবকদের জন্যও ‘নয়নতারা বিদ্যালয়’- রাকেশ বসু
Next articleকাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে চাই ধীর স্থির মনোভাব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here