রাগ মানেই রোগ নয়

জগতে এমন কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার কখনো রাগ হয়নি। অবুঝ শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ- রাগ সবার-ই হতে পারে। যেকোনো অনাকাঙ্খিত, অসহনীয় ঘটনা বা পরিস্থিতিতে মানুষের রাগ হতে পারে। ঘটনা ভেদে, ব্যক্তি ভেদে, সময় ও পারিপার্শ্বিকতা ভেদে রাগের মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু ‘আমার কখনো রাগ হয় না- নিজের কাছে সৎ থেকে এ কথাটি কেউ কখনো বলতে পারবেন না।

রাগ মানুষের মানবিক বোধের অংশ- আনন্দ, দুঃখ, বিরক্তি, ভয়, বিস্ময়-এর মতো মানুেষর মৌলিক একটি আবেগ। ঘটনার প্রেক্ষিতে মাঝে-মধ্যে রাগ হওয়াটাও অস্বাভাবিক বা তেমন ক্ষতিকর বলা যাবে না। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখন-ই যখন রাগের বহিঃপ্রকাশটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে ব্যক্তির সাধারণ জ্ঞান, নম্রতা, ভদ্রতাবোধ ও লজ্জাসংকোচ লোপ পেতে পারে, ব্যক্তি হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে যেকোনো ধরনের দর্ঘুটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন- যা ব্যক্তির নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
অনিয়ন্ত্রিত রাগের অগ্রহণযোগ্য বহিঃপ্রকাশে যেমন জীবনযাপনের স্বাভাবিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে পারে, পারস্পরিক সম্পর্কে দূরত্ব বা বিচ্ছেদ ঘটতে পারে, তেমনি বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি থেকে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।

রাগ ও রাগের অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশ কেন হয়? মহাকালের নানা বাঁকে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী, গবেষক, মনীষী। ধারণা ও গবেষণা থেকে এ সম্পর্কে নানা জন দিয়েছেন নানা মত, ব্যাখ্যা, তত্ত্ব। অস্ট্রিয়ান নিউরোসায়েন্টিস্ট ও ‘সাইকোঅ্যানালাইসিস’ এর জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিগুলির একটি হচ্ছে নিজের প্রতি ধ্বংসাত্মক মনোভাব। কিন্তু প্রবৃত্তি এই ব্যক্তির নিজের জন্য ক্ষতিকর বিধায় অবচেতনে এই প্রবৃত্তির বিপক্ষে আত্মরক্ষামূলক আচরণ বা ডিফেন্স মেকানিজমের কারণে মানুষ অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়।

কানাডিয়ান-আমেরিকান সাইকোলজিস্ট আলবার্ট বান্দুরা ‘সোশ্যাল লার্নিং’ মতবাদ অনুযায়ী, ব্যক্তি পরিবেশ ও সমাজ থেকেই অনিয়ন্ত্রিত রাগের প্রকাশ শেখে। রাগ প্রকাশের কারণে ব্যক্তি তার পারিপার্শ্ব থেকে কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয় বা ফল লাভ করে, যা তাকে পুনরায় রাগের বহিঃপ্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন, রাগ করে আগ্রাসী বা আক্রমণাত্মক হওয়ার ফলে অন্যরা ব্যক্তির ইচ্ছে পূরণ করে বা তাকে সমীহ করে, এভাবে অন্যের উপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ ব্যাপারটি ব্যক্তি দেখেও শেখে। যখন ব্যক্তি দেখে অন্য কেউ রাগের বহিঃপ্রকাশের ফলে উপকৃত হচ্ছে বা তাৎক্ষণিক কাঙ্খিত ফল পাচ্ছে, তখন সে-ও একই ধরনের আচরণ করতে উৎসাহিত হয়। রাগের বহিঃপ্রকাশ বা আগ্রাসী আচরণের বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় মতবাদটি দিয়েছেন আমেরিকান সাইকোলজিস্ট জন ডোলার্ড। তার মতবাদটি ‘ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিস’ নামেই পরিচিত।

এই তত্ত্ব অনুসারে, মানুষের লক্ষ্য পূরণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া বা নিষ্ফলতা ও ব্যর্থতা থেকে তৈরি হওয়া হতাশার-ই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে রাগের প্রকাশ। আমেরিকান সাইকোলজিস্ট ক্রেইগ অ্যান্ডারসন এবং ব্রাড বুশম্যান এর ‘জেনারেল এগ্রেশন মডেল’ অনুযায়ী, ব্যক্তিগত, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক, জৈবিক ও মানসিক বিষয়াবলীর মিথষ্ক্রিয়ায় রাগ ও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ব্যক্তি কোনো কারণে মানসিক চাপে থাকলে, দৈনন্দিন নানা চাপের মোকাবেলায় অসমর্থ হলে, বা অতিরিক্ত দুিশ্চন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে দিন যাপন করলে উপেক্ষণীয় ঘটনাতেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন বা রেগে যেতে পারেন।

প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত কিছু বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব থাকে, যা দিয়ে তাকে অন্য মানুষ থেকে পৃথক করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের অংশ। ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক গঠন, বংশগতি, প্রাকৃিতক সামাজিক পরিবেশ প্রভৃতির আন্তঃ মিথস্ক্রিয়া এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ব্যক্তির বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াতেই ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত হয়। কোনো কোনো মানুষের ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে রাগ ও রাগের প্রকাশ। যারা ছোটকাল থেকেই সহজে রেগে যায়, রাগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাদেরকে আমরা রগচটা, বদরাগী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করি। তারা নির্দিষ্ট কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত না-ও হতে পারেন- এই রাগ ও রাগের প্রকাশ তার ব্যক্তিত্বের অংশ বলেই প্রতিভাত হয়। রাগ মানেই রোগ নয়। কিন্তু, কিছু মানসিক রোগ রয়েছে যেগুলোর অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত রাাগ বা রাগের অস্বাভাবিক ও আগ্রাসী প্রকাশ।

অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার-এর মতো ব্যক্তিত্বের ত্রুটিজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। মানসিক রোগী মাত্রেই রাগী বা আগ্রাসী- এ ধারণাটি সত্য নয়, বাস্তব-ভিত্তিক নয়। স্বাভাবিক, নিরোগ মানুষও যেমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রেগে যেতে পারেন এবং এর অস্বাভাবিক প্রকাশ ঘটাতে পারেন, তেমনটি ঘটতে পারে যেকোনো মানসিক রোগীর বেলায়। তবে, কিছু মানসিক রোগীর বেলায় রাগ নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার অভাব দেখা যায়। আবার, রোগীর আত্মীয় বা অন্য মানুষেরা বুঝে বা না বুেঝ রোগীকে রাগিয়ে দেন।

সিজোফ্রেনিয়া এবং এ ধরনের রোগে আক্রান্তদের মধ্যে যারা ভ্রান্ত বিশ্বাস বা সন্দেহপ্রবণতায় ভোগেন, তারা সন্দেহের বশে বা তাদের ভুল বিশ্বাসের ফলে কাউকে শত্রু বা প্রতিপক্ষ ভেবে রেগে যেতে এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার বা ম্যানিয়ার মতো রোগে আক্রান্তদের কথা বা কাজে বাধা দিলে বা তাদের মতের বিপক্ষে কিছু করলে কেউ কেউ অল্পতেই রেগে যেতে পারেন।

মাদকাসক্তির প্রভাবে স্বাভাবিকতা ও যৌক্তিকতা হারিয়ে ব্যক্তি অকস্মাৎ রাগী আচরণ প্রকাশ করতে পারেন। বিষণ্ণতা ও অতি উদ্বেগজনিত রোগীরাও কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণহীন রাগে ফেটে পড়তে পারেন। রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে ঠিক কি কারণে, কি পরিস্থিতিতে বা ঘটনায় অথবা অন্যের কি ধরণের আচরণে আপনার রাগ ওঠে। এটা বের করতে প্রয়োজনে প্রতিবার রাগ হওয়ার পর এর কারণ এবং সে সময়ে আপনার শারীরিক-মানসিক অনভুূতি ও ভাবনা ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারেন। রাগ ওঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বা রাগ উঠলে তাৎক্ষণিক সে পরিস্থিতি বা স্থান থেকে সরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। সেটা সম্ভব না হলে রাগের সময়ে চুপ করে থাকা ভাল। কেননা, রাগের মাথায় যা বলা হয় তা অপ্রীতিকর এবং অযৌক্তিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ সময়ে কথা না বলে বরং ইতিবাচক কোনো কিছু ভাবতে বা আনন্দদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করতে পারেন। তাৎক্ষণিক মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়াটাই মূল লক্ষ্য। ফোন দিতে পারেন কাছের কোনো বন্ধুকেও। তবে রাগের কথা না বলে বরং অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন।

সবচেয়ে জরুরি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। কোনো ঘটনার ইতিবাচক দিকটি বেশি করে দেখার মানসিকতা গড়ে উঠলে হুট-হাট রেগে যাওয়ার প্রবণতা কমে। নির্দিষ্ট কোনো মানসিক রোগের কারণে হঠাৎ করে অনিয়ন্ত্রিত রাগের সমস্যা দেখা দিলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসা করতে হবে।

সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

Previous articleউদ্বাস্তু মহিলা: মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং মানসিক আঘাত
Next articleচিন্তাশক্তি বাড়ায় গাছে চড়ার অভ্যাস
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here