গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন এর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালে যত জন ধর্ষিত হয়েছে তার থেকে প্রায় দুই শত বেশি ধর্ষিত হয়েছে ২০১৭ সালে। বিগত কয়েকদিন ধরে পত্রিকা জুড়ে ধর্ষণের যে খবর পাচ্ছি তাতে এটা স্পষ্ট যে ২০১৯ এর শেষে ধর্ষণের সংখ্যা অন্যান্য বছরগুলো থেকে বেশিই হবে। দেখা যাচ্ছে পত্রিকা খুললেই কোথাও না কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে। শিশু-কিশোরী-যুবতী-গৃহবধূ-পাগলি-মাদ্রাসায় পড়া বালক সবাই ধর্ষণের শিকার। আমরা রাগে ফুঁসছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ধর্ষণ থামছেই না। মুক্ত পরিবেশে ধর্ষণের হুমকিও দিচ্ছে কেউ কেউ।
দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে, মধ্যবিত্তরা ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে বেশিরভাগ সময়ই চেপে যায় মান সম্মানের কথা ভেবে। যার ফলে সেসব ঘটনার খবর পত্রিকায় আসে না। থানায় কোনো কেস তো হয়ই না। স্ট্রেইঞ্জার রেপ এবং গ্যাং রেপগুলোর খবরই আমরা শুধু জানি। একেকটা ধর্ষণের খবর আসার পরে সোস্যাল মিডিয়াতে যে ধরনের শাস্তির প্রস্তাবনা আসে তা দেখলে বোঝা যায় ধর্ষণকে আমরা কতটা ঘৃণা করি। তবু ধর্ষণ রোধ করা যাচ্ছে না। ধর্ষণের একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আর তার জন্য প্রয়োজন ধর্ষকামী মানুষটাকে চেনা। যৌন নিপীড়ন বলতে শুধু যে ধর্ষণকেই বোঝায় তা নয়। শ্লীলতাহানি, ইভ টিজিংয়ের মতো ছোটখাট বিষয়গুলোও যৌন নিপীড়নের মধ্যে পড়ে।
কিছুদিন ধরে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে পেলাম মেয়েরা টি শার্টে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না ’ লিখে প্রতিবাদ করছে। পাবলিক প্লেসে কারো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যৌন উত্তেজনার স্বাদ নেয়া আরেক ধরনের যৌন নিপীড়ন। সত্যি কথা বলতে কী, কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করে তাকে দিয়ে যৌন আনন্দ পেতে চাওয়ার চেষ্টা করাটাই যৌন নিপীড়ন। যৌনতার ক্ষেত্রে অনুমতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম সকল পর্যায়ের অনুমতিই এখানে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে নিপীড়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের অনুমতিই প্রধান। যৌনতা তখনই উপভোগ্য যখন সেটা পারস্পারিক অনুমতির সাপেক্ষে হয়। কে যৌন নিপীড়ন করবে কে করবে না তা এখান থেকেই অনুমান করা যেতে পারে। যারা যৌনতাকে উপভোগ করতে না চেয়ে ভোগ করতে চায় তারা পারস্পারিক অনুমতির কথা ভাবে না। প্রতিপক্ষের ওপর জোর খাটিয়ে তারা যৌনতাকে ভোগ করতে চায়। এই যে আগ্রাসী মনোভাব যৌন নিপীড়নের জন্য এই মনোভাব বা অ্যাটিচিউড দায়ী।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যৌন নিপীড়নের পেছনে মানুষের এই আগ্রাসী মনোভাব জড়িত। তবে এই একটা বিষয়কে দায়ী করেই বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। আরো আরো গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে আরো কিছু তথ্য, যা থেকে আমরা একজন যৌন নিপীড়কের মনস্তত্বটা বুঝতে পারি। যৌন নিপীড়কের মনস্তত্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার সারসংক্ষেপ পাঠকদের সুবিধার্থে তুলে ধরছি। শৈশবে নিপীড়ন ছেলেবেলায় যারা নির্যাতনের শিকার হয় তাদের পরবর্তীতে যৌন নির্যাতন করার প্রবণতা থাকে। শিশু বয়সে মানুষ তিনভাবে নির্যাতনের শিকার হয়-শারীরিক, মানসিক এবং যৌন। এই তিন ধরনের নির্যাতনের মধ্যে যারা মানসিকভাবে নির্যাতিত হয় সঙ্গীর প্রতি তারা বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তাছাড়া বাবা-মায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক না থাকলে সেটাও পরবর্তীতে তাদের সন্তানদের মধ্যে সঙ্গীর প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
যৌন আচরণ যাদের অল্প বয়সে যৌন অভিজ্ঞতার সূত্রপাত হয় এবং একাধিক যৌন সঙ্গী থাকে তাদের যৌন নিপীড়ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধু একাধিক যৌন সঙ্গীই নয়, গবেষণায় দেখা গেছে-যারা যৌনতার ক্ষেত্রে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় না এবং সম্পর্কের বাইরেও যৌন সম্পর্ক তৈরি করাকে কিছু মনে করে না তাদের দ্বারাও যৌন নিপীড়ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সামাজিক দক্ষতা যাদের সামাজিক দক্ষতা কম তারা সম্পর্কের চাইতে যৌনতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাদের সহমর্মিতা বোধ কম থাকে। তারা অন্যের সমস্যা বুঝতে পারে না। অযাচিত যৌনতা অন্যের কাছে কেমন লাগবে সেটা তারা বুঝতে পারে না। তারা প্রতিপক্ষের ইঙ্গিত বুঝতে ভুল করে। অপর পক্ষ যৌন আগ্রহ না দেখালেও তারা ভুল করে আমন্ত্রণ মনে করে। দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনা নারীর প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ধর্ষণ নিয়ে প্রচলিত মতবাদে তারা বিশ্বাসী যেমন ‘পোশাকের কারণে ধর্ষণ হয়’; ‘নারীদের আচরণ ধর্ষককে প্রলুদ্ধ করে’; ‘যৌন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়’ ইত্যদি। বন্ধু-বান্ধব ধর্ষণের প্রতি বন্ধু-বান্ধবদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ যৌন নিপীড়নে ভূমিকা রাখে। ধর্ষণকে সমর্থন করে এমন লোকদের সাথে যারা মেশে তাদেরও ধর্ষণ করার প্রবণতা থাকে।
মাদকাসক্তি অ্যালকোহলের সাথে ধর্ষণের একটি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। অ্যালকোহলের প্রভাবে প্রতিপক্ষের ইঙ্গিতকে ভুলভাবে নেয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই কয়টি বিষয়ই উঠে এসেছে গবেষণায়। তবে এর কোনো একটাকে এককভাবে দায়ী করা যায় না। কনফ্লুয়েন্স মডেল অব সেক্সুয়াল অ্যাগ্রেশন অনুসারে বলা যায়, সবগুলো বিষয়ের এক সম্মিলিত প্রভাব পড়ে ধর্ষকের মননে। দুটি উপায়ে বা পথে এই বিষয়গুলো কাজ করে। প্রথমটা হিংসাত্মক অতি পুরুষালি পথ আর দ্বিতীয়টি নৈর্ব্যক্তিক যৌনতার পথ। নারী ধর্ষণকারীদের নিয়েই গবেষণা বেশি হলেও বালক ধর্ষণকারী অথবা পুরুষ ধর্ষণকারী নারীদের নিয়েও গবেষণা হয়েছে। সব গবেষণাতেই ঘুরে ফিরে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো-যৌন আগ্রসন।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।