সূচনা
যোগ, এই শব্দতা সংস্কৃত শব্দ ‘ইউয্’ থেকে এসেছে যার মানে হল একত্রিত; আত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগ। পতঞ্জলির সংঞ্জানুসারে যোগ মানে হল মনের পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিভিন্ন ধরণের যোগ থাকলেও, প্রত্যেক ধরণের যোগের উদ্দেশ্য হল মনকে নিয়ন্ত্রণ বা বশ করা।
যোগ সম্পর্কিত যে ধারণা (বিভিন্ন শারীরিক ভঙ্গিমা ও আসন) বর্তমানে সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে তা সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই প্রচলিত ছিল। তখন থেকেই এটা অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং এখন আমরা যাকে যোগাভ্যাস বলে জানি তা প্রকৃত যোগাভ্যাসের থেকে অনেকটাই আলাদা।
এখানে যোগ-এর এই বিবর্তনের বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ
বেদের আগের যুগ (৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আগে)
কিছুদিন আগেও পশ্চিমের শিক্ষিতরা এটাই বিশ্বাস করতেন যে যোগ আবিষ্কৃত হয় ৫০০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে যখন বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রপাত হয়। যদিও, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োর সর্বশেষ খনন কার্যের ফলে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে যোগের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবিও আছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে খ্রীষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগেও যোগাভ্যাসের প্রচলন ছিল। যদিও, এই বক্তব্যের লিখিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বৈদিক যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০)
বৈদিক যুগে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে যোগাভ্যাস করা হত, মনঃসংযোগ বাড়ানোর জন্য এবং দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য। এখনকার যুগের যোগাভ্যাসের থেকে তখনকার ধর্মীয় আচারের যোগাভ্যাস অনেকটাই আলাদা ছিল। বৈদিক যুগের ধর্মীয় আচারগুলোই ছিল যোগের সংঞ্জা – আত্মার সাথে পরমাত্মার যোগ।
প্রি-ক্ল্যাসিকাল বা ঊপনিষদের যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০)
ঊপনিষদ, মহাভারত ও গীতাতে যোগের উল্লেখ দেখা যায়। ভগবৎগীতাতে ঞ্জান যোগ, ভক্তি যোগ, রাজ যোগ ও কর্ম যোগ এই চার প্রকারের যোগেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতার উপদেশে শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে যদি কোন ব্যক্তি নম্রতা ও নিষ্ঠার সাথে বাস্তবতাকে খোঁজে তাহলে তিনি উচ্চ মার্গের চেতনা লাভ করেন। সেই সময়, যোগ শুধুমাত্র শ্বাস বা ভঙ্গিমা সংক্রান্ত অভ্যাস ছিল না, তা ছিল প্রাত্যহিক জীবনের একটা অঙ্গ।
ক্ল্যাসিকাল যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৪ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৪৮)
ক্ল্যাসিকাল যুগে পতঞ্জলি ১৯৫টা সূত্রকে একত্রিত করে যোগকে একটা সংক্ষিপ্ত আকার দেন। পতঞ্জলির যোগ দর্শন রাজ যোগ নামেই পরিচিত। এর মোট আটটা শাখা আছে – ইয়ম্ (সামাজিক বিধি), নিয়ম (ব্যক্তিগত বিধি), আসন (শারীরিক ভঙ্গিমা), প্রাণায়াম (শ্বাস-প্রশ্বাসের বিধি), প্রত্যাহার (চেতনা কে সরিয়ে রাখা), ধারণ (মনঃসংযোগ), ধ্যান ও সমাধি। যদিও, আগেকার যোগাভ্যাসে পতঞ্জলি বেশ কিছু শারীরিক ভঙ্গিমা ও শ্বাস বিধির সংযোগ করেছিলেন সেগুলো ব্যবহার করা হত শুধুমাত্র ধ্যান ও সমাধির আনুষঙ্গিক হিসাবে। পতঞ্জলির সূত্রে কোন আসন বা প্রাণায়ামের নাম পাওয়া যায় না।
পোস্ট ক্ল্যাসিকাল যুগ (৮০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ)
এই সময়ে পতঞ্জলিযোগের অনুগামীরা আসন, ক্রিয়া ও প্রাণায়ামের দ্বারা শরীর ও মনের শুদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে যোগাভ্যাসকে একটা নতুন মাত্রা দেন। এই শরীর ও মনের শুদ্ধি এই যোগাভ্যাসকারীদের সমাধির মত উচ্চ মার্গের সাধনাতে সাহায্য করত। এই ধরণের যোগ কে বলা হয় হট্ যোগ।
আধুনিক যুগ (খ্রীষ্টাব্দ ১৮৬৩ পরবর্তী)
শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর কাছে যোগকে পৌঁছে দেন। অনেক যোগী পুরুষ যেমন মহর্ষি মহেশ যোগী, পরমহংস যোগানন্দ, রামন মহর্ষি ও আরও অনেকে পশ্চিম বিশ্বকে তাঁদের আধ্যাত্মিক ঞ্জানে এতটাই অনুপ্রাণিত করেন যে সারা বিশ্বই যোগকে ধর্ম নির্বিশেষে আধ্যাত্মিকতার এক অন্যতম অঙ্গ হিসাবে গ্রহন করেছে, কোন বিশেষ ধর্মের আচার হসাবে নয়।
আধুনিক সময়ে, টি কে কৃষ্ণমাচার্য তাঁর তিন শিষ্য বি কে এস্ আয়ান্গার, পট্টভি জয়েস্ এবং টি ভি কে দেসিকাচার কে যোগাভ্যাসের শিক্ষা দেন; তাঁর এই শিষ্যরা সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলেন।
উপসংহার
বর্ত্মানে আমরা যে যোগাভ্যাস করি তা হয়তোবা প্রাথমিক কালের যোগের থেকে অনেকটাই আলাদা, কিন্তু পতঞ্জলির যোগ-দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই এরও সৃষ্টি হয়েছে। আজকাল যে তফাৎটা দেখা যাচ্ছে তা হল আজ আমরা মনের সুস্থতার থেকে বেশী শরীরের সুস্থতার দিকে নজর দিচ্ছি।