নিভৃতচারী এক কিংবদন্তি তিনি। তিনি মরমী ও আধ্যাত্মিক ভাবনার কবি। লেখনীর মাধ্যমে তিনি মানব মনে মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলেন। বলছিলাম মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরীর কথা। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই ও প্রবন্ধ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় স্থান পায়। এই বয়সেও তিনি প্রাণবন্ত এবং নিরন্তরভাবে মানবতার কল্যানে সাহিত্য সাধনায় কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ১৯টি। এ পর্যন্ত তিনি রচনা করছেনে ২০০০ গান, অসংখ্য কাব্য,
গীতিনাট্য, সমাজ সারমূলক বই। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর দেশ ও বিদেশের লেখকরা লিখেছেন ২৪টি গ্রন্থ। তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী। মনের খবর তারকার মন বিভাগের এবারের পর্বে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো মনের খবর প্রতিনিধি মো. মারুফ খলিফার সাথে এই মরমী কবির একান্ত আলাপচারিতার কিছু অংশ।
কেমন আছেন?
ভালো আছি।
এত বছর বয়সেও একবাক্যে ভালো আছি বলে ফেলতে পারেন, এর জন্য কোনটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন?
এর জন্য সৃষ্টিকর্তার করুণা এবং তারপর আমার নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করি ।
আপনার লেখালেখির শুরু সম্পর্কে যদি একটু বলতেন।
এটা আসলে অনেক বিস্তৃত। গ্রামীণ আবহ এবং পারিবারিক আবহ সব মিলে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আমার ছোটোবেলা থেকেই। আমার পড়ালেখা শুরু গ্রামের বাড়িতেই। তখন আমাদের ওখান থেকে সবুজ বাংলা নামে একটি পত্রিকা বের হতো। আমার বড়ো ভাই সেখানে লিখতেন। সেখানে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তখন সবাই সেই কবিতার খুব প্রশংসা করলেন। সেই থেকে নিয়মিত কবিতা চর্চার আগ্রহটা আরো বেড়ে গেল।
লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনি মন দ্বারা কতটা প্রভাবিত?
সে সবচেয়ে ভালো লেখক যে নিজের সমালোচনা করতে পারে। আমি যখন কোনো কিছু লিখি তখন সহজে কলম ধরি না। আগে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি, তারপর মন যেভাবে সায় দেয় সেভাবে লিখি।
আপনার লেখা মানুষের মনকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
প্রত্যেক লেখকেরই একটা নিজস্ব ধরন থাকে, স্বকীয়তা থাকে। নিজের মতো করে লেখার স্বাধীনতা সবারই আছে। তবে লেখকের লেখা যদি আমার দেশের ১৫ আনা মানুষ
তথ্য সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে তাহলে লেখকের স্বার্থকতা নেই বলে আমি মনে করি। আমি চেষ্টা করি সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য এবং সহজপাঠ্য ভাষায় লিখতে।
আপনার তো অনেক অর্জন, নিজের কোন অর্জনকে এগিয়ে রাখবেন?
আমার আসলে কোনো অর্জন নেই বলে আমি মনে করি। তবে আমার অনেক চাওয়া আছে, আমার সবচেয়ে বড়ো চাওয়া হলো, মানুষের বসবাসের জন্য পৃথিবী শান্তিময় হোক ।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে জরুরি কী বলে মনে করেন?
বনের পশুরা একসাথে মিলে বাসা করতে পারে। কিন্তু মানুষ সেটা পারে না, মানুষ সামান্য স্বার্থের জন্য মানুষকে হত্যা করছে। মানুষ স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি, শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মানুষ বদলালেই কেবল পৃথিবী বদলাবে ।
আপনার পূর্ণতার পাল্লা ভারী, এরপরও কোনো অপূর্ণতা আছে কি?
আমি মানুষের কল্যাণে অনেক বেশি কাজ করতে চেয়েছি। তার সবটা হয়তো করে যেতে পারিনি, এটাই আমার সবচেয়ে বড়ো অপূর্ণতা। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের
সবচাইতে বড়ো শক্তি হল তার জ্ঞান। আর সমাজে এই জ্ঞান বিতরণ করেন শিক্ষকরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক কম, অন্য চাকুরির তুলনায় তাদের সুযোগ-সুবিধাও কম। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সার্বিক মর্যাদা এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা যেন বৃদ্ধি পায়, এটা আমার সব সময়ের চাওয়া ছিল। এটি এখনো পূরণ হয়নি।
আপনার ভালো লাগা, মন্দ লাগা সম্পর্কে কিছু বলুন ।
আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা দুটোই মানুষকে ঘিরে। যা কিছু মানুষের জন্য কল্যাণকর তা আমার ভালো লাগে আর যা কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা আমাকে
ব্যথিত করে।
ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ কোনটি বলে মনে করেন?
ভালো মানুষ হওয়ার জন্য মনের শুদ্ধতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মন শুদ্ধ না হলে কারো পক্ষে ভালো কাজ করা সম্ভব নয়।
মনকে শুদ্ধ রাখার জন্য করণীয় কী বলে মনে করেন?
মনকে শুদ্ধ রাখার জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সুন্দর চিন্তা করা, যেকোনো ভালো কাজের সাথে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করা, মানবিক হওয়া এবং ভালো ভালো বই
পড়া । মনের শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি, যেকোনো সফলতার জন্য মনে শক্তি রাখাটা জরুরি।
আপনার লেখায়ও এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়, আপনার মতে ন্যায়, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এগুলো কি চর্চার মাধ্যমে বিকশিত করা সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব। তার জন্য পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই সাথে সামাজিক রীতি—নীতিও একটা বড় ভূমিকা এখানে পালন করতে পারে।
লেখালেখিতে আপনার সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা কী?
আমার একাগ্রতা, সময়ানুবর্তিতা, পাঠাভ্যাস, মানবপ্রেম এগুলোই আমার লেখার জন্য সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা।
স্মৃতিকাতরতা আছে?
আমার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। আমি আমার জীবনে দেখা বিভিন্ন সময়কে স্পষ্টতই স্মরণ করতে পারি। লেখার জন্য সেখান থেকে উপকরণ সংগ্রহ করি। এটাকে আসলে স্মৃতিকাতরতা বলা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটা সময়েরই একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, তাই আমি চলমান সময় থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি সময়ের অগ্রগতি এবং অবনতি বিশ্লেণের চেষ্টা করি।
রাগ, ক্ষোভ, অভিমান আপনার মধ্যে কেমন আছে?
রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এই বিষয়গুলো বোধহয় সব মানুষের মধ্যে কম বেশি থাকে। এরপর সেটা সময় এবং বয়সের সাথে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আমার মধ্যে এই ব্যাপারগুলো সবসময়ই কম ছিল। এর পেছনে বড় কারণ ছিল বোধহয় মানবপ্রেম। আমি মানুষকে প্রচণ্ড পরিমাণে ভালোবাসি তাই এইসব নেতিবাচক বিষয়গুলো আমার
মধ্যে প্রশ্রয় পায়নি।
আমরা জানি যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের একাকিত্ব বাড়তে তাকে। আপনার বয়স এখন ৯৫ বছর। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বার্ধক্য এবং একাকিত্ব
বিষয়ে কিছু যদি বলতেন—
বার্ধ্যক্যে মানুষের শরীর এবং মনে অনেক ধরনের রোগ বাসা বাঁধে। আমি বলি বার্ধক্য নিজেই একটা রোগ। আল্লাহর রহমতে আমি এই বয়সে অন্যদের তুলনায় কম
রোগ শোকে আছি। এর পেছনে আল্লাহর কৃপা এবং আমার নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি। আর একাকিত্ব এই সময়ে স্বভাবতই মানুষকে ঘিরে ধরে। কারণ, এই সময়ে তাদের আশেপাশে মানুষের সংখ্যা কমে যায়। আমাদের দেশেই প্রায়ই দেখা যায়। বার্ধক্যে মানুষ একদমই একা হয়ে যায়। তাই প্রত্যেক মানুষেরই উচিত বার্ধ্যকের সময়টা কীভাবে কাটাবে তার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি রাখা। আর বার্ধক্যের একাকিত্ব মোকাবেলায় স্বজনদের সংস্পর্শ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন ও জীবিকার জন্য ছেলে মেয়ে বা অন্যান্য নিকটজনেরা হয়ত দূরে থাকতে পারেন। তবে সংস্পর্শের জন্য দূরত্বটা প্রতিবন্ধকতা নয়। নিয়মিত যোগাযোগটাই বড়ো কথা। এই যোগাযোগ তথা প্রিয়জনের সংস্পর্শ বার্ধক্যের একাকিত্ব দূর করতে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রাখে। আর আমি যেহেতু এখনো লিখতে পড়তে পারি। তাই আমার ভেতরে একাকিত্ব বোধটা এখনো সেভাবে ভর করতে পারেনি।
মন তো নিশ্চয়ই খারাপ হয়। এই বয়সেও যখন মন খারাপ হয় তখন মন ভালো করার জন্য কী করেন?
আমার সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র হচ্ছে লেখালেখি । মন খারাপ হলে লেখালেখি বা পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। আর তার আগে মন খারাপের কারণ বিশ্লেষণের
চেষ্টা করি।
লেখালেখির ক্ষেত্রে মনের সুস্থতা কতটা জরুরি বলে মনে করেন?
মানসিক সুস্থতা ছাড়া ভালো লেখালেখি সম্ভব নয়। সাধারণ অর্থে আমরা মানসিকভাবে অসুস্থকে ‘পাগল’ বলেই বিবেচনা করি। একজন মানসিক অসুস্থ কিংবা ‘পাগল’ লোক কখনো সমাজের কল্যাণে মানবতার কল্যাণে ভালো কিছু লিখতে পারে না। শুধু লেখালেখি নয়, শারীরিক সুস্থতার জন্যও মানসিক সুস্থতা সবচেয়ে জরুরি বলে আমি মনে করি।
আপনি জীবনে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। রাজপথের আন্দোলন, বন্দুকের সামনে আন্দোলন, লেখালেখি —সব মিলে কি কখনো অতিরিক্ত মানসিক চাপ বোধ করেছেন কিংবা কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন?
বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে কাউন্সেলিং অপরিহার্য। আমাদের দেশে মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটু কম সচেতন। তাই আমাদের সময়ে কাউন্সেলিং ধারণাটাই মানুষের ছিল না। তাই প্রয়োজন থাকলেও মানুষ বুঝতো না যে এই সময়ে কাউন্সেলিং পেলে সে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারত। আমি অনেক সময় কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও তখন আমাদের দেশে ওরকম সুযোগ না থাকাতে নেওয়া হয়নি।
আপনার ভবিষ্যৎ—পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলুন?
আল্লাহ আমাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখেন আমি সব মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য লিখেই যাব। আর যতটুকু সামর্থ্য আছে তার সর্বোচ্চ দিয়ে মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করে যাব।
ভালোবাসা এবং স্বপ্ন ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখেন?
ভালোবাসা মানুষের জীবনের অপরিহার্য উপাদান। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ কিংবা স্রষ্টার সৃষ্টির প্রেমে পড়ি। ভালোবাসার কোনো স্থান, কাল, পাত্র, বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই । ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর। আর স্বপ্ন ছাড়া সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, স্বপ্নহীন মানুষ মূল্যহীন।
আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে করণীয় হিসেবে কোনো পরামর্শ দেবেন কি?
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার জন্য প্রচারণার বিকল্প নেই। বই, পত্র—পত্রিকায় লেখালেখি, টেলিভিশনে এই সমস্ত বিষয়ে বেশি বেশি প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পাৱে ।
মনের খবরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মনের খবরকেও ধন্যবাদ। মানসিক স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে তারা অনেক বড়ো ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি ।