জ্বর, সর্দি বা ব্যথা হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া আমাদের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজে প্রচলিত নানা ভুল ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে মানসিক চিকিৎসা এখনো অনেকের কাছে অস্বস্তির বিষয়। অথচ সময়মতো চিকিৎসা নিলে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা আসক্তির মতো সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে কথা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল- এর মানসিক রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাতেমা জোহরা’র সঙ্গে। তিনি মনে করেন—মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা শুধু ওষুধ নয়, বরং সহানুভূতি ও বোঝাপড়ার বিষয়। রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো পেশায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মনের খবর: কেমন আছেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, কাজের ব্যস্ততায় আছি। একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ভালো থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধু ব্যক্তিগত সুখের জন্য নয়, বরং রোগীদের ভাল এবং সঠিক সেবা প্রদানের জন্যও অপরিহার্য।
মনের খবর: সাম্প্রতিক সময়টা কেমন কাটছে আপনার?
ডা. ফাতেমা জোহরা: দায়িত্বের কারণে ব্যস্ততা বেড়েছে, তবে কাজের মধ্যেই মানসিক তৃপ্তি খুঁজে পাই। অন্যদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় চিকিৎসকরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারেন না। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের নিয়মিত নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে একজন থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া, মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন করা, এবং চাপমুক্ত থাকার জন্য ব্যক্তিগত কৌশল খুঁজে বের করা জরুরী।
মনের খবর: বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ব্যস্ততা কেমন যাচ্ছে?
ডা. ফাতেমা জোহরা: আগের তুলনায় দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। শুধু চিকিৎসা নয়, প্রশাসনিক বিষয়েও নজর রাখতে হচ্ছে।মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা একটি পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র। নতুন গবেষণা, থেরাপির পদ্ধতি, এবং ওষুধের ব্যাপারে সবসময় আপডেটেড থাকা উচিত। এতে করে একজন চিকিৎসক নিজেকে আরও দক্ষ এবং আত্মবিশ্বাসী মনে করেন, যা তার মানসিক সুস্থতার জন্যও সহায়ক।
মনের খবর: এই ব্যস্ততার মাঝে পরিবারকে কিভাবে সময় দিচ্ছেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: পরিবারের সমর্থন ছাড়া এসব কাজ সম্ভব নয়। যতটুকু সম্ভব সময় বের করার চেষ্টা করি।কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কাজের পর পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, শখের পিছনে সময় দেওয়া, এবং সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া একজন চিকিৎসককে মানসিকভাবে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
মনের খবর: মানসিক রোগ চিকিৎসার পেশা বেছে নেওয়ার দিদ্দ্বান্ত কিভাবে নিলেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: এখানে রোগীকে শুধু ওষুধ নয়, মানবিক সহায়তাও দিতে হয়। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই এই পেশায় আসা।
মনের খবর: মানসিক রোগ চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও প্রাপ্তি কোনটি বলে মনে করেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক কুসংস্কার ও ভুল ধারণা ভাঙা। আর প্রাপ্তি হলো—একজন রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারলে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা অন্য পেশায় সম্ভব না।
মনের খবর: বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগ বিভাগে কী ধরনের সেবা কার্যক্রম ও চিকিৎসার ধরণ সম্পকে একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরবেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: আমরা বহির্বিভাগে নিয়মিত সেবা দিই, প্রয়োজন হলে ভর্তি রাখা হয়। কাউন্সেলিং, ওষুধ, সাইকোথেরাপি, মানসিক সমস্যার পাশাপাশি অনান্য শারীরিক সমস্যা —সব ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে।
মনের খবর: মানসিক রোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কতটা বদলেছে বলে আপনি মনে করেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। তবে এখনও লজ্জা বা কুসংস্কারের কারণে অনেকে চিকিৎসা নিতে চান না।
মনের খবর: ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগ বিভাগে কী কী ধরণের মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়?
ডা. ফাতেমা জোহরা: ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, আআত্মহত্যার চিন্তা, অতিরিক্ত রাগ ও জেদ, ঘুমের সমস্যা, এছাড়াও বাচ্চাদের ও বয়স্কদের বিভিন্ন মানসিক রোগের চিকিৎসা, বিভিন্ন প্রকার আসক্তি—সবকিছুর চিকিৎসা দেওয়া হয়।
মনের খবর: বর্তমানে কোন কোন আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বা থেরাপি চালু রয়েছে?
ডা. ফাতেমা জোহরা: ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা, কাউন্সিলিং, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি, গ্রুপ কাউন্সেলিং।
মনের খবর: সরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক কোনটি?
ডা. ফাতেমা জোহরা: বর্তমানে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি আছে। সরকার এই খাতকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।
মনের খবর: মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা ও কুসংস্কার কীভাবে চিকিৎসার অগ্রগতি ব্যাহত করছে?
ডা. ফাতেমা জোহরা: অনেকে এখনও মনে করেন মানসিক রোগ মানে পাগল। এজন্য রোগী বা পরিবার চিকিৎসা নিতে দেরি করে।
মনের খবর: আপনি কীভাবে মানসিক রোগ চিকিৎসায় এই সামাজিক বাধাগুলো ভাঙতে কাজ করছেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: আমরা নিয়মিত সচেতনতা কর্মসূচি, সেমিনার কমিউনিটি লেভেলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করি।
মনের খবর: চিকিৎসা সেবার প্রসারিত জনবল, অবকাঠামো, ও প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে কী কী সমস্যায় মুখোমুখি হন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: জনবল কম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত সাইকোলজিস্টের অভাব আছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও বড় চ্যালেঞ্জ।
মনের খবর: ভবিষ্যতে সেবার দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কীভাবে একটি মডেল হিসেবে তুলে ধরা যায় বলে আপনি মনে করেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: যদি আরও প্রচার ও গবেষণার সুযোগ তৈরি করা যায় তবে এই হাসপাতাল মডেল হতে পারে।
মনের খবর: বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলো সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ডা. ফাতেমা জোহরা: আমরা রোগীদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং সেশন চালু করেছি, জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচারণা করেছি। মানসিক সমস্যার পাশাপাশি তাদের শারীরিক সমস্যা হলে তা হাসপাতালের অনান্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মনের খবর: ভবিষ্যতে বিভাগের উন্নয়নের জন্য আপনি কী ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান?
ডা. ফাতেমা জোহরা: জনবল বাড়ানো, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা।
মনের খবর: বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরও কার্যকর করতে হলে সরকারের কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন বা পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: জনবল নিয়োগ, বাজেট বৃদ্ধি, এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
মনের খবর: মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্ষেত্রে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বা আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
ডা. ফাতেমা জোহরা: হ্যাঁ, পাঠ্যক্রমে আরও জোর দেওয়া উচিত। পাশাপাশি কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন করলে শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হবে।
মনের খবর: মানসিক রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতায় মিডিয়া, পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডা. ফাতেমা জোহরা: এই তিনটি ক্ষেত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া সচেতনতা বাড়াতে পারে, পরিবার রোগীকে সহায়তা দিতে পারে, আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক জ্ঞান ও সহমর্মিতা গড়ে তুলতে পারে।
মনের খবর: একজন চিকিৎসক ও শিক্ষক এই পরিচয়ে আপনি দীর্ঘদিন কাজ করছেন। নতুন প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় আগ্রহী চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী হবে?
ডা. ফাতেমা জোহরা: মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা শুধু রোগের লক্ষণ নির্ণয় এবং ওষুধ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি রোগীর প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং বোঝাপড়ার উপর নির্ভর করে। একজন ভালো চিকিৎসককে রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং তাদের কষ্টকে উপলব্ধি করতে হবে। সহানুভূতি দিয়ে রোগীর বিশ্বাস অর্জন করা গেলে চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যায়। মানসিক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রটি প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে। নতুন গবেষণা, থেরাপির পদ্ধতি এবং চিকিৎসার সরঞ্জাম আসছে। একজন চিকিৎসক হিসাবে সবসময় নতুন কিছু শেখার এবং নিজেকে আপডেটেড রাখার মানসিকতা থাকা জরুরি। এতে রোগীদেরকে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাটি দেয়া যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের রোগীদের চিকিৎসা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। একজন চিকিৎসক হিসাবে অনেক মানসিক চাপ এবং কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারে। তাই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত বিরতি নেওয়া, শখের পিছনে সময় দেওয়া এবং প্রয়োজনে সহকর্মী বা সুপারভাইজারের সাথে আলোচনা করা দীর্ঘমেয়াদি এই পেশায় টিকে থাকতে সাহায্য করবে।
মনের খবর: মনের খবরের পাঠকদের উদ্দেশ্য মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা নিয়ে কিছু বলুন।
ডা. ফাতেমা জোহরা: আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক স্বাস্থ্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন সুস্থ না থাকলে শরীরও সুস্থ থাকে না। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া একটি সুস্থ ও সুখী জীবনের জন্য অপরিহার্য। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, বা অন্য যেকোনো মানসিক সমস্যা হলে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ঠিক যেমন শারীরিক অসুস্থতায় আমরা ডাক্তারের কাছে যাই, তেমনি মানসিক অসুস্থতায়ও একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সাহায্য নেওয়া জরুরি। মনের যত্ন নেওয়া কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি নিজের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধারই প্রকাশ।
মনের খবর: মনের খবর এর কার্যক্রম কতোটা উপকারী এবং প্রয়োজনীয়?
ডা. ফাতেমা জোহরা: মনের খবর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং মানুষের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। মনের খবর এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এই ভুল ধারণাগুলো ভাঙতে এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য করতে সাহায্য করে। এই ধরনের উদ্যোগগুলো মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করতে উৎসাহিত করে, যা সমাজের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
“বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে আমরা ধারাবাহিকভাবে বিশেষ সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। সেই ধারারই অংশ আজকের এই আলাপচারিতা।”
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
আরও দেখুন-