‘১১ বছর বয়সে আমার মানসিক রোগ দেখা দেয়। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা আমাকে আমার এই মানসিক সমস্যা একাই বয়ে বেড়াতে বাধ্য করছিলো। এতে করে আমার সমস্যাগুলো বেড়েই যাচ্ছিল এবং একসময় আমার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তীব্র হতে শুরু করে। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাস আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধা দিচ্ছিলো। একসময় আমি ধূমপান ও মদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ি। ১৫ বছর বয়সে আমি চিকিৎসা নেয়া শুরু করি, যদিও ধূমপান ও মদের নেশা তখনও ছাড়িনি। পরবর্তীতে চিকিৎসার পাশাপাশি ‘ইয়োগা’ ও অন্যান্য থেরাপি নেয়া শুরু করি। ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হতে থাকি এবং নেশাদ্রব্য গ্রহণ ছেড়ে দেই।’
জগন্নাথ লামিচেনের ব্যক্তিগত জীবনের এই অভিজ্ঞতাটি গার্ডিয়ান পত্রিকা হতে সংগৃহিত; যিনি একাধারে নেপাল মানসিক স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক, কলামিষ্ট ও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতাকর্মী।
দীর্ঘ রোগভোগের পর জগন্নাথ লামিচেন যখন সুস্থ হলেন তখন এটা উপলদ্ধি করলেন যে, ‘মানসিক রোগ জীবনকে স্থবির করে দেয়’ কথাটি ঠিক নয়। এ ধারণাই তাকে পরবর্তীতে মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। কাজ করতে গিয়ে সম্মুখীন হন নানা প্রতিকূলতার। এমনকি তার কাছের বন্ধুরা যখন জানতে পারল তার মানসিক রোগে ভোগার কথা তখন তারাও ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। কাজ করে গেছেন মানসিক রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে।
সমাজ নানাবিধ ভ্রান্ত ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ এখনও বিশ্বাস করে, মানসিক রোগের চিকিৎসায় কোন লাভ নেই, সে নিজেও ভোগে, অন্যদেরও ভোগায়। তার দ্বারা আর কোন কিছুই সম্ভব না। জীবনের পথচলা বোধ হয় এখানেই শেষ।
পথ চলতে চাইলেও সঙ্গী হতে চায় না অন্যরা, বরং বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানাভাবে, নানা আলোচনায়, সমালোচনায়। অথচ লামিচেনের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়ে দেয়, মানসিক রোগ জীবনকে থামিয়ে দেয় না, পথচলা রুদ্ধ করে না।
শুধু লামিচেন কেন, বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি যারা তাদের নিজ নিজ জায়গায় রাজত্ব করে গেছেন মানসিক রোগ নিয়ে। কার্ল স্যান্ডবার্গের জীবনীগ্রন্থে দেখা যায়, আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন Severe Depression এ ভূগতেন। শুধু তাই নয়, আত্মহত্যার প্রবণতাও তার মধ্যে ছিল তীব্র। অথচ ৪ বছর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন সুনামের সাথে। রচনা করে গেছেন গণতন্ত্রের একটি অসাধারণ সংজ্ঞা।
A Beautiful Mind সিনেমাটি যারা দেখেছেন তারা হয়ত জানেন যে, এই সিনেমাটি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ‘জন ন্যাস’ এর জীবনী নিয়ে তৈরি; যিনি সারা জীবন নিজের সাথে যুদ্ধ করে গেছেন ‘সিজোফ্রেনিয়া’ নামক জটিল মানসিক রোগটি নিয়ে।
২০০৮ সালের অলিম্পিক গেমসের কথা কি আমরা ভূলে গেছি। সেই অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাতারু মাইকেল ফেলপস ৮টি স্বর্ণপদক পেয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন, সেই ফেলপস্ ছোটবেলায় Attention Deficit Hyperactivity Disorder রোগে ভূগেছিলেন।
মানসিক রোগে ভোগা বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকা খুব ছোট নয়। সেই তালিকায় আছেন- আরনেস্ট হেমিংওয়ে, লিনডা হেমিলটন, আলবার্ট আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন, জর্জ ওয়াশিংটন, হাওয়ার্ড হিউজেস এবং আরও অনেকে। সেলিব্রেটিদের মধ্যে এলটন জন, ব্র’ক শিল্ড, জেটা জোনস্, মেল গিবসন, জিম ক্যারি ছাড়াও আরও অনেকে।
এই বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাদের নিজ নিজ জায়গায় যে অবদান রেখে গেছেন তার ফল আজও আমরা ভোগ করি। ইতিহাস যত দীর্ঘই হোক না কেন, মানুষ তাদের স্মরণ করবে যুগে যুগে। অথচ এরা সবাই কোন না কোন মানসিক রোগে ভুগেছেন। এই রোগটি তাদের জীবনটাকে নিঃশেষ করে দেয়নি, দেয়নি মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে সারাজীবন বাঁচতে বরং এই রোগের সাথে যুদ্ধ করেই পথ চলেছেন, হেরে যাননি রোগের কাছে। রোগ নিয়ে মানুষের বিদ্রুপ ও সমালোচনার জবাব দিয়েছেন নিজের কাজের মাধ্যমে। দেখিয়ে দিয়েছেন মানসিক রোগ জীবনের ঘড়ির কাঁটাকে অচল করে দেয় না।
লেখক: ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব
ফেস-বি (রেসিডেন্ট), মনোরোগবদ্যিা বভিাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।