মানসিক রোগ চিকিৎসায় কার কী ভূমিকা?

মানসিক রোগ ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, ‘বিশ্বে প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এর দ্বারা আক্রান্ত হয়। যদিও অনেক লোক এতে আক্রান্ত হয়, তবু লোকেরা মানসিক রোগকে গোপন করে রাখে, উপেক্ষা করে এবং এটাকে খারাপ চোখে দেখে।’ শুরুতে মানসিক রোগকে বিভিন্ন ভূত‚ প্রেত, অপদেবতার প্রকোপ বা সৃষ্টির্কতার শাস্তি বলে ভাবা হলেও এই ধ্যানধারণার পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৮ শতকের পর থেকে। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক ঔষধ আবিষ্কৃত হয়। এরপর সময়ের সাথে সাথে মানসিক রোগ চিকিৎসারও অগ্রগতি সাধিত হয়।
আগে মানসিক রোগীকে অ্যাসাইলাম বা পাগলা গারদে শেকলবদ্ধ করে রাখা হলেও এখন বলা হয়, হাসপাতাল থেকে যথাসম্ভব দ্রুত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে রোগীকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু দ্রুত তাদেরকে পারিবারিক পরিবেশে ফেরত পাঠানো এত সহজ বিষয় নয়। এর জন্য চাই দলবদ্ধ ভূমিকা। যে দলে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাইকিয়াট্রিস্ট প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

সাইকিয়াট্রিস্টের কাজ হচ্ছে রোগীর রোগ নির্ণয় করা ও চিকিৎসা কী হবে তা ঠিক করা। অর্থাৎ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের  ‍মূল দায়িত্ব হচ্ছে, মানসিক রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধসহ, মনোসামাজিক চিকিৎসা ও অন্যান্য পরামর্শ প্রদান করা। চিকিৎসা হিসেবে ঔষধ বা সাইকোথেরাপি বা উভয়েরই প্রয়োজন হতে পারে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট উভয় ক্ষেত্রেই পারদর্শী হন। ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা শুধুমাত্র একজন সাইকিয়াট্রিস্টই দিতে পারেন। তবে তিনি প্রয়োজন অনুসারে সাইকোথেরাপির জন্য রোগীকে মনোবিদের (Psychologist) বা সাইকোথেরাপিস্টের কাছে রেফার করতে পারেন।

সাইকোলজিস্ট হচ্ছেন মানুষের আচার ব্যাবহারের ওপর অভিজ্ঞ এমন ব্যক্তি যাঁরা কিনা মানুষের মন কীভাবে কাজ করে, সুস্থ মানসিক পরিবেশের জন্য কী কী ফ্যাক্টর প্রয়োজন অর্থাৎ, এককথায় মানুষের মানসিক সুস্থতা নিয়ে কাজ করেন। আর সাইকথেরাপির ওপর বিশেষভাবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাইকোথেরাপিস্ট বলা হয়। সাইকোথেরাপি একটি বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাপদ্ধতি যা দিয়ে একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং তাকে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শেখানো যায়। এই চিকিৎসা একজন মানুষের মনের অস্বাস্থ্যকর চিন্তাগুলো দূরে সরিয়ে, তাকে নতুন কৌশল শিখিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শেখায়। কার্যকর সংযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা, সমস্যা সমাধান করতে পারা, সিদ্ধান্ত নিতে শেখা, নতুন কৌশল শেখা এবং নানা রকম বিনোদনের পথ ধরে সাইকোথেরাপি মানুষকে তাদের সমস্যাগুলো সামলাতে শেখায়। এই সাইকথেরাপি যেমন একজন মনোরোগ চিকিৎসকও দিতে পারেন তেমনি একজন সাইকোলজিস্ট বা সাইকোথেরাপিস্টও দিতে পারেন। মানসিক রোগীদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করা কিন্তু খবু একটা সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটি করে থকেন মানসিক রোগ সেবিকা বা সাইকিয়াট্রিক নার্স। এই রোগ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকলে তা রোগীর চিকিৎসায় জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে শুধু ঔষধ দেয়াই তাদের কাজ নয় বরং রোগের লক্ষণগুলোর ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হয় তাঁদের।

শুরুতেই বলেছি এখন মানসিক রোগ চিকিৎসায় রোগীকে দ্রুত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু চেনা পরিবেশটাই অচেনা হয়ে যায় যখন একজন মানসিক রোগী হাসপাতাল থেকে ঘরে ফেরেন। পরিবার ও সমাজ কি তাঁকে আর সেই আগের অবস্থানে দেখে? সমালোচনা ও পদে পদে প্রতিবন্ধকতা তাঁর চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করে। আর এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মীদের ভূমিকা খবুই গুরুত্বপর্ণূ। সমাজকর্মীরা মূূলত রোগীর পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাঁর প্রয়োজনগুলো খুঁজে বের করেন, সেগুলো পেতে সাহায্য করেন ও পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কাজ করেন। তাছাড়া রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে রোগী ও তাঁর পরিবারকে ধারণা দেন।

একজন রোগীকে শুধু সুস্থ করে তোলাই  ‍মূল উদ্দেশ্য নয় বরং যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে কর্মক্ষম করে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ক্ষেত্রে অকুেপশনাল থেরাপির ভূমিকাও কম নয়। অকুপেশনাল থেরাপি হচ্ছে এমন একটি স্বাস্থ্যসেবামূলক পেশা যা একজন ব্যক্তিকে তাঁর

শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে তাঁর সীমাবদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, শারীরিক-মানসিক বা সামাজিকভাবে অক্ষম একজন ব্যক্তিকে দৈনন্দিন কাজে তার সামর্থ্য অনযুায়ী স্বনির্ভর করা। এক্ষেত্রে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করেন, যা তাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

সাধারণত আমাদের দেশের একজন মানুষের ভালোমন্দ প্রাথমিকভাবে দেখভাল করে থাকে পরিবার। তাই মানসিক রোগ চিকিৎসায় পরিবারের ভূমিকা ভুলে গেলে চলবে না। পরিবারকে রোগীর রোগের লক্ষণ বুঝে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন যেমন হতে হবে তেমনি মানসিক বা আর্থিকসহ সবধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দর্ভুাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বেশিরভাগ পরিবারে রয়েছে মানসিক রোগ নিয়ে অজ্ঞতা। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করাতে অনেক পরিবারই আর্থিকভাবে অক্ষম। তাই পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকাও জরুরি। কিন্তু সমাজেও রয়েছে মানসিক রোগীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা। অথচ এই নেতিবাচক ধারণা দূর না হলে তাদেরকে স্বাভাবিক স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা কঠিন।

তাই এইসব নেতিবাচক ধারণা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মিডিয়া। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সবাইকেই। রাষ্ট্রকেও এই রোগের চিকিৎসায় ভূমিকা নিতে হবে যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকেই রোগের চিকিৎসা শুরু করা যায়। রোগীকে সুচিকিৎসা প্রদান করাসহ পনুর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকেই যেন রোগী সহজে ঔষধ পেতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা ও চিকিৎসকদেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মানসিক রোগীকে বোঝা না ভেবে সম্পদে রূপান্তর করার দায়িত্ব কিন্তু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং এর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবারই। প্রত্যেকেই যদি তার নিজ অবস্থান থেকে যার যা ভূমিকা তা সঠিকভাবে পালন করতে পারে তবেই একসময় তারা আর আমাদের বোঝা হয়ে থাকবে না বরং সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করতে এগিয়ে আসতে পারবে।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

Previous articleনিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশের প্রয়োজনীয় কিছু কৌশল
Next articleপ্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here