মানসিক রোগে শারীরিক লক্ষণ

মানসিক রোগে
মানসিক রোগে শারীরিক লক্ষণ

কামরুল সাহেব অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। দিনে দিনে নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। শুরুটা বছর তিনেক আগে মাথাব্যথা দিয়ে। প্রথমে অল্প অল্পই হতো। বাড়তে বাড়তে তা এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে চোখে ঝাপসা দেখা, হাঁটুতে ব্যথা, পেটে অস্বস্তি থেকে শুরু করে শতেক রকমের সমস্যা। চোখের ঘুম হারাম। সারাদিন অসুখ নিয়েই চিন্তা। প্রথমে নিজে নিজে ঔষধ কিনে খেতেন, তারপর ঔষধের দোকানদার, এল.এম.এ.এফ, স্থানীয় এম.বি.বি.এস ডাক্তার, শহরের বড়ো প্রফেসর-অনেককেই দেখিয়েছেন। শুধু অ্যালোপ্যাথি নয়, যাবতীয় সবধরনের চিকিৎসাই নেয়া হয়ে গেছে। প্রথম কিছুদিন ভালো লাগে, তারপর আবার সেই একই দশা।
বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা দেখেন, টেস্ট করান একগাদা, শেষে বলেন, ‘আপনার তো কোনো সমস্যা নাই, তাও কয়েকটা ঔষধ লিখে দিচ্ছি খেয়ে দেখেন, আশা করি ভালো লাগবে।’ ভালো তো আর লাগে না, কামরুল সাহেবও আর উনাদের কাছে যান না। একবার গিয়েছিলেন আর সেই ডাক্তার উপদেশ দিলেন মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে। শুনে উনার এমন রাগ হলো-রোগ ধরতে পারে না, রোগী ভালো করতে পারে না, উল্টো রোগীকে বলে পাগল! সেই থেকে একের পর এক ডাক্তার দেখিয়েই চলেছেন, ডাকটিকিটের মতো হাজারো প্রেসক্রিপশনের সংগ্রহ তৈরি হয়েছে, ডাক্তার-চেম্বার-ঔষধের নামের জীবন্ত অভিধান হয়ে গিয়েছেন; কিন্তু সুস্থ আর হতে পারছেন না। বন্ধু-বান্ধবরা পরামর্শ দিলেন, ‘বাংলাদেশে আবার চিকিৎসা হয় নাকি! দেশের বাইরে যাও।’ টাকা বেশি থাকলে সিঙ্গাপুরই যেতেন, তা যখন হচ্ছে না তখন ভারতেই যাবেন।
তবে দেশে শেষ চেষ্টা হিসেবে ঢাকার সর্বোচ্চ চিকিৎসাকেন্দ্রে এসেছেন এক বেয়াইয়ের পরামর্শে। বহির্বিভাগের বারান্দায় বসে আছেন দেখানোর জন্য। কথায় কথায় এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। কথা বলে জানলেন সেই ভদ্রলোকের কাহিনিও অনেকটা তার মতোই। উনার ছিল পেটের গন্ডগোল। এখানে বলা হয়েছে, এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। একমাস ঔষধ খেয়ে এখন বেশ ভালো আছেন, দ্বিতীয়বার দেখাতে এসেছেন। ভদ্রলোকটিও প্রথমে মানতে চাননি ডাক্তারদের কথা, তবে এখন অনেক ভালো লাগছে-তাই বুঝতে পারছেন কথাটা সত্যি। এই প্রথম কামরুল সাহেবের মনে নিজের ভাবনার ওপর সংশয় এলো। তবে কি তিনি এতদিন ভুল করেছেন? ছাত্রজীবনে ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাই মনে পড়ে গেল একটি লাইন-‘খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর’।
তবে কি তিনিও ‘পরশপাথর’ কবিতার খ্যাপার মতো? এ পর্যন্ত লেখাটা গল্পের মতো শোনালেও নামটা বাদে আর সবই সত্যি। প্রমাণ হিসেবে আপনার আশেপাশে এরকম দুয়েকজন পেয়েও যেতে পারেন। হয়ত ভাবছেন-তবে কি এসব রোগীর আসলেই কোনো সমস্যা নেই? সবকিছুই কি মানসিক? এটা আবার কী ধরনের কথা-রোগটা মানসিক, কিন্তু যন্ত্রণা শারীরিক! অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী টাইপ রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটা কী? তাহলে চলুন, কিছু সাধারণ কথা জেনে নেয়া যাক।
আমরা প্রায় সবাই মন এবং শরীরকে দুইটি আলাদা ব্যাপার ভাবতে অভ্যস্ত হলেও, এরা যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ। আবার, শারীরিক অসুবিধার কারণে মন খারাপ হওয়াও আমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। অতএব, মনের কারণে যে শারীরিক অসুবিধা হতে পারে তাতে আর কী সন্দেহ। সমস্যা হয় তখনই যখন কেউ বলে, ‘এই যে আমার এত শারীরিক কষ্ট, যার জন্য এক দুর্বিষহ জীবন আমি ভোগ করছি, তার কারণ আসলে মানসিক।’ শুনতেই মনে হয়, যেন একটা লোক কোনো সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই এসব করছে, লোকটা আসলে ভন্ডামী করছে, ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না কিংবা লোকটা আসলে পাগল হয়ে গেছে।
তবে সত্যি কথা হচ্ছে, এসবের কোনো কিছু না হয়েও মানসিক রোগের কারণে শারীরিক লক্ষণ বা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেটা কীভাবে? সে কথাতেই আসা যাক। সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন, আপনাকে একজন দাওয়াত দিল, বেশ ভালো ভালো খাবার আপনার সামনে আনা হলো। এখন আপনি যদি ঐদিন খুব প্রফুল্ল মনে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই উপভোগ করবেন খাবারগুলো। কিন্তু যদি কোনো কারণে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মানসিক অবস্থায় শুধু দাওয়াত রক্ষা করতেই যান, তবে সেই একই খাবার আর তেমনভাবে উপভোগ্য হবে না। আশা করি, এই বিষয়টায় কারো দ্বিমত থাকবে না। কিন্তু কেন এমন হলো? সহজেই বোঝা যায়, মনের অবস্থার তারতম্যের কারণেই এটা ঘটল।
এবার একটু গভীরে যাওয়া যাক। মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণাদি প্রকাশ পাওয়ার পেছনে কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। যেমন : Somatization, Dissociation, Conversion। মানসিক কষ্ট বা অসুবিধা শারীরিকভাবে প্রকাশ পাওয়াকেই সাধারণভাবে Somatization বলা হয়। আর Dissociation বলতে এমন একটা মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিকে বোঝায় যেখানে সচেতনতা বা সজ্ঞানতার সঙ্গে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধন ব্যাহত হয়। অন্যদিকে, মানসিক চাপ বা যন্ত্রণা যখন শারীরিক অসুবিধা বা লক্ষণে পরিবর্তিত হয়ে যায় তখন সেই পরিবর্তিত হওয়ার পদ্ধতিকে Conversion বলা হয়ে থাকে।
এই সম্ভাব্য পদ্ধতিগুলোর কার্যকরী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন : কারো কারো মানসিক চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতা কম, কারো মেনে নেয়ার ক্ষমতা কম, কেউ কেউ সমস্যায় পড়লে সহায়তা পাওয়ার বা সমাধানের পথ খুঁজে পান না, কেউ কেউ মানসিক চাপ মোকাবেলার বা মানসিক চাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভুল পদ্ধতি বেছে নেন। আবার, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের এই অংশটাতে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হিসেবে কাজ করে। যেমন : আমাদের সমাজে মন খারাপ বা ভালো না লাগা বা দুশ্চিন্তায় ভোগাটাকে কোনো সমস্যা হিসেবেই ধরা হয় না। উল্টোদিকে শারীরিক কোনো সমস্যাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সেটা যদি ব্যথা হয়, দুর্বলতা হয় বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া হয় তবে আরো বেশি গুরুত্ব পায়।
তাই এসব মানসিক অসুবিধায় ভুগতে থাকা লোকজন সহায়তা পেতে পারেন এমন ব্যক্তির কাছে বা চিকিৎসকের কাছে শারীরিক লক্ষণ নিয়েই উপস্থিত হন। ফলে মন খারাপ বা বিষণ্ণতার অধিকাংশ রোগীই ব্যথা-বেদনা, দুর্বলতা নিয়ে, উদ্বিগ্নতার রোগীর বুক ধড়ফড়, নিশ্বাস আটকে যাওয়া নিয়ে অথবা কনভার্শন ডিজঅর্ডারের রোগী অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনির মতো লক্ষণ নিয়ে হাজির হন।
মনে রাখবেন, শরীর-মন দুটো আলাদা বিষয় নয়। আর তাই, মানসিক সমস্যায় যেমন শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, একইভাবে শারীরিক রোগেও মানসিক রোগের লক্ষণ থাকতে পারে। করণীয় হচ্ছে, প্রতিটা বিষয়কেই যথাযথ গুরুত্ব দেয়া। বিশেষ করে, মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে কেউ ভুগলে তা নিজেকেই আগে স্বীকার করে নিতে হবে, সহায়তা চাইতে হবে। আবার, কোনো শারীরিক লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীকে কোনো চিকিৎসক যদি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে চান, তবে তাতে আতঙ্কিত না হওয়া বা তা অবজ্ঞা না করাই উচিত। সবশেষে বলতে হয়, সমস্যাকে অস্বীকার করে নয়, তাকে স্বীকার করে বা মেনে নিয়ে নির্দিষ্ট পথে এগোনোর মাধ্যমেই শুধু মিলতে পারে কাঙ্ক্ষিত সমাধান।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত।

Previous articleযেকোনো কাজেই অস্থিরতা
Next articleযৌনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ হরমোন টেস্টোস্টেরন কম হওয়ার লক্ষণ
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here