মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি : সমাজ তাদের কীভাবে দেখে ?

0
71
আমাদের সমাজে মানসিক প্রতিবন্ধকতা কে এখনও রোগ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা কোনও রোগ নয়, এটা একটা অবস্থান। এই প্রতিবন্ধকতার শিকার যারা, তাদের বুদ্ধিমত্তা বয়স অনুপাতে বাড়ে না ,ফলে স্বাভাবিক সমবয়সি সব ছেলেমেয়েদের থেকে সর্বক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ে। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ মেন্টাল রিটার্ডেশন (AAMR) এর মতে “মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’রা মূলত বর্তমান অবস্থায় কাজকর্মে যথেষ্ট অক্ষম এবং সেই সঙ্গে স্বাভাবিকের তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তি অতি অল্প। তাছাড়া তাদের মধ্যে  অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ,নিজের পরিচর্যা নিজে করা ,পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করা ,সামাজিক তৎপরতা ,নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালনা ,স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, পড়াশুনা, অবসর এবং বিনোদন ইত্যাদি আনুষঙ্গিক আচরণেও সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা লক্ষ করা যায়।”

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’রা নানা ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ, অপব্যবহার, অবহেলা ও বিব্রতকর অভিজ্ঞতার শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন। এর পেছনে সচেতনতার বড় ধরনের ঘাটতি এবং এ বিষয়ে প্রচার প্রচারণার অভাবকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের সমাজে এরকম কু-সংস্কার প্রচলিত আছে যে, এই প্রতিবন্ধীত্ব একটা অভিশাপ যা পাপ কর্মের শাস্তি।

মানসিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের নানা দৃষ্টিভঙ্গি :

১. সোশ্যাল স্টিগমা : সমাজের মানুষ কর্তৃক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নানা ভাবে হেয় করা,  বৈষম্যমূলক আচরণ করা, অবহেলা, কলঙ্ক দেয়া এবং তাদের ন্যায্য অধিকার না দেয়াই মূলত সোশ্যাল স্টিগমা। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি আসে সমাজের নানা কু-সংস্কার থেকে।

২. কু-সংস্কার : আমরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধিতা নিয়ে নানারকম ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস, কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা শুনে থাকি। ধর্মের অপব্যাখ্যা, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-ধারণা, পুরোনো ধ্যানধারণা, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত প্রতিবন্ধিতা ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যদিও সেগুলোর কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের এই অবস্থাকে আমরা তার এবং তার পরিবারের পাপ কর্মের সাঁজা হিসেবে দেখে তাদের প্রতি অমানবিক হই।

৩. সমাজ থেকে বিকেন্দ্রিকরনঃ প্রতিবন্ধিতা কখনো সংক্রামক কোনো রোগ নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা পরিবার ঘনিষ্ঠ হলেও তা অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। অথচ সামাজিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী শিশুর সঙ্গে খেলতে না দেওয়া, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে না দেওয়া সম্পূর্ণরূপে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। আর এভাবে মূলধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে না পারার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখে নিজেদের অভিশপ্ত বলে মনে করে ও হীনম্মন্যতায় ভোগে।

৪. শিক্ষা থেকে বঞ্চিত : প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে। তাদের জন্য উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা নাই। সুশিক্ষা একটি হাতিয়ার। এ হাতিয়ারের মাধ্যমে বিদ্যালয় পর্যায় থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু ভালো ফলাফল অর্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন জ্ঞান অর্জনের বিষয়কে গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধিতাসংক্রান্ত ভ্রান্তধারণা ও অপব্যাখ্যা সমাজ থেকে দূরীভূত হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও আমাদের মতো সন্তান, ভাই, বোন, আমাদের মতো নাগরিক, আমাদের মতো তাদেরও এ সমাজে সমান অধিকার রয়েছে—এ বিষয়গুলো সবাইকে বুঝতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সীমিত সক্ষমতাকে পরিচর্যা করে ন্যায্যতাভিত্তিক সুযোগ প্রদান করলে তারাও সফল হতে পারবে। কাজেই, সামাজিক সকল কুসংস্কার ও নেতিবাচক ধ্যানধারণা পরিহার করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের আলোকিত টেকসই সমাজ গঠনের অন্যতম নিয়ামক।

ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ (এনএসপিডি) ২০২১’-এর তথ্য বলছে, প্রতিবন্ধী শিশুদের (৫-১৭ বছর বয়সী) মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে। মোট ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে। সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে যে, প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা তাদের বয়স অনুপাতে শিক্ষাগতভাবে গড়ে দুই বছরের বেশি পিছিয়ে।

বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম বলেন- “এই প্রথম বিবিএস প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংক্রান্ত একটি জাতীয় জরিপ পরিচালনা করেছে। এই জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য প্রতিবন্ধী শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় কত প্রকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা তুলে ধরেছে। রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করবে”
Previous articleটাইগারদের ‘পারফরম্যান্স সাইকোলজিস্ট’ ফিল জন্সি’র দৌড়ঝাঁপ
Next articleপ্যারেনটিং স্টাইল এবং সন্তানের সহিংস আচরণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here