মাদকাসক্তি কি ফ্যাশন?

0
44
বিবাহ

আমরা আজ বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে সময়ের সাথে সাথে মাদকের সম্পৃক্ততা, মাদক গ্রহণের কারণ, মাদকাসক্তি কিভাবে মানব মস্তিষ্কসহ নানা অঙ্গের উপর প্রভাব বিস্তার করে, এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করবো। তাহলে হয়তোবা খুঁজে পাবো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর। যেমন, একজন মাদকাসক্ত কি শুধু ফ্যাশনের ট্রেন্ড থেকেই মাদক গ্রহণ করেন? কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের এমন কি পরিবর্তন আসে, যা মানুষকে মাদক গ্রহণে প্রভাবিত করে? বাংলাদেশে মাদকাসক্তির মূল কারণ কী ? সর্বোপরি মাদকাসক্তি কি ফ্যাশন? এক কথায় এই প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বা না বলার দেওয়ার চেয়ে আজ বরং বিভিন্ন আঙ্গিকে এর উত্তর খুঁজে নেই চলুন।

যুগে যুগে মাদকাসক্তির পেছনের কারণগুলো জটিল ও বহুমুখী। আমরা যদি একটু পেছনের ইতিহাস থেকে ঘুরে আসি তাহলে দেখতে পাই ১৯৬০ সালে পশ্চিমা সমাজে তরুণদের মধ্যে কাউন্টার—কালচার আন্দোলন খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি ছিল মূলত তৎকালীন সময়ে প্রচলিত সমাজ ও সংস্কৃতি বিরোধী একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনে প্রচলিত মূল্যবোধের বিপরীতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে দাঁড় করানো হয়েছিল। সেসময়ের তরুণদের একটি অংশ সামাজিক স্তর—ভাগ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও পরিবারের সংজ্ঞায়নকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ, সেসময়ের মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থাকে অস্বীকার করার পাশাপাশি ভিন্ন বাস্তবতা ও অনুভূতিকে প্রত্যক্ষ করার নিমিত্তে, মারিজুয়ানা ও এলএসডির মতন নানা ধরনের মাদকেও তখনকার তরুণরা আসক্ত হয়ে পড়ে। মাদক মানুষকে আত্ম উপলব্ধি ও সচেতন করতে সাহায্য করে এমন একটি বিশ্বাস একাংশের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে সমাজ ও সংস্কৃতিকে আমরা ব্যক্তি কেন্দ্রিক, বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদী হিসেবে বর্ণনা করতে পারি। এই সময়ে মাদকদ্রব্য কোকেন হিরোইন প্রায় সারা পৃথিবীতে সহজলভ্য হয়ে পড়ে। নিজের স্বাধীনতাকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এ সময় মাদকের ওপর অনেক তরুণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আবার ২০০০ ও ২০১০ সালের বিশ্ব ও সমাজ ব্যবস্থায় যদি আমরা মাদকাসক্তির কারণ খুঁজতে যাই, তাহলে মানসিক চাপ উদ্বেগ ও অন্যান্য আবেগজনিত সমস্যাগুলোকে সামনে আনা যায়। একই সাথে প্রচলিত মাধ্যমগুলোতে মাদককে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়, যেমন— গান, সিনেমা, টিভি শো, তার ভূমিকা চোখে পড়ে। প্রেসক্রিপশন থেরাপিউটিক ড্রাগের অপব্যবহার এবং মাদকের সহজলভ্যতাকেও আমরা অনেকাংশে দায়ি করতে পারি।

উপরের উদাহরণগুলো থেকে আমরা কিছুটা ধারণা পাই যে, সময়ের সাথে সাথে সমাজের নানাবিধ বিবর্তন নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাদককে অনেক সময় সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করেছে। কিছু বিপথগামীরা সমাজের এই বিবর্তনগুলোর বাঁকে মাদকগ্রহণকে ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছে। মাদকাসক্তি নিয়ে আবার এটি বলাও যথার্থ নয় যে, সব মাদকসেবী ভাবেন, মাদক গ্রহণ একটি ট্রেন্ড। একজন ব্যক্তির আসক্তির পেছনে অনেকগুলো কারণই থাকতে পারে। সামাজিক সংঘের সাথে নিজেকে মানানসই করার অভিপ্রায়, মিডিয়া ও জনপিয় ভিন্ন—ধারার সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ছাড়াও, মানসিক ও আবেগীয় চাাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য শৈশবের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে ভুলতে এবং আত্মসচেতনতার অভাবকেও মাদকাসক্তির পেছনের কারণ হিসেবে বলা যায়। গোটা পৃথিবীর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা দেখি, অতীতে পরিবারের কারও মাদক গ্রহণের ইতিহাস যাকে ফ্যামিলি হিস্ট্রি বলে সেটা ৪০—৬০% ক্ষেত্রেই মাদকাসক্তির জন্য দায়ি। অতীতের যেকোনো শারীরিক এবং মানসিক ট্রমা ২৫—৪০% ক্ষেত্রে দায়ী, পরিবেশ ও নানাবিধ মানসিক রোগ ১৫—২০% ক্ষেত্রে একজন মানুষকে মাদকাসক্ত করে তুলতে পারে। শুধুমাত্র ৫—১০% ক্ষেত্রেই তরুণদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়া প্রবণতা, সঙ্গদোষ মাদকাসক্তির পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। আবার বাংলাদেশের আর্থ—সমাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ১৫—৩০ বছর বয়সী কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার বেশী। এখানে একজন মাদকাসক্তের গড় বয়স ২২ বছর। জার্নাল অব হেলথ, পপুলেশন এন্ড নিউট্রিশন মতে, দেশে ৬৫% মাদকসেবী অবিবাহিত, ৫৬% ছাত্র অথবা বেকার, ৯৫% ধুমপায়ী, ৮৫% সঙ্গদোষেই মাদক গ্রহন শুরু করে।
আমরা যদি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মাদকাসক্তিকে বিশ্লেষণ করতে যাই তাহলে দেখি, মাদক গ্রহণ মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে সক্রিয় করে। রিওয়ার্ড সেন্টার আনন্দ, উৎসাহ ও শিখন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ নিউরো—সায়েন্স একটি স্টাডিতে বলে, মাদকের চাহিদা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য করা আচরণ দিয়ে সৃষ্টি হয়। যেমন একজন ব্যক্তি মাদক নেন এবং এর ফলে সাময়িক অতি আনন্দ উপভোগ করেন। এটি এক ধরনের অ্যাসোসিয়েটিভ লার্নিং। যার মানে, একটি নতুন উদ্দীপনার ওপর ভিত্তি করে কিছু করতে শেখা। মাদক গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কের ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের দ্রুত ক্ষরণ ও বৃদ্ধি হয়, এটি মাদক গ্রহণকারীকে সাময়িক আনন্দ ও তীব্র উচ্ছ্বাস দেয়। একই সাথে এটিও মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে সক্রিয় করে যা পরবর্তীতে আবার মাদক গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। ক্রমাগত মাদক ব্যবহারের ফলে মাদকের উপাদানের প্রতি টলারেন্স তৈরি হয়। টলারেন্সের জন্য পূর্বের মতো মাদক গ্রহণ পরবর্তী আনন্দ ও তীব্র উচ্ছ্বাস বা ইউফোরিয়া পেতে মাদকের পরিমাণ/ডোজ বাড়াতে হয়। এভাবে ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে এক পর্যায়ে মাদক গ্রহণ অভ্যাসে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন মাদক ব্যবহারকারীদের ডোপামিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় এবং মস্তিষ্কের যেসব জায়গা ডোপামিনের মাধ্যমে সক্রিয় থাকে ও তথ্য আদান প্রদান করে সেই জায়গাগুলো এবং মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন হয়। দেখা যায় প্রি—ফন্ট্রাল কর্টেক্স যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ি, ক্রমাগত মাদক গ্রহণের ফলে তা সঠিকভাবে কাজ করে না। মস্তিষ্কের এমিগডালা যা আবেগীয় প্রক্রিয়া, চাপ ও উদ্বেগ অনুভূতির সাথে জড়িত। ক্রমাগত মাদক গ্রহণের ফলে সেটিও সঠিকভাবে কাজ করে না। নিয়মিত মাদক গ্রহণ এমিগডালার ক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়, যা পুনরায় মাদক গ্রহণের ইচ্ছাকে উৎসাহিত করে। এছাড়া হিপ্পোক্যাম্পাস যা স্মৃতি তৈরি ও শিখন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত তা মাদক গ্রহণ সংক্রান্ত স্মৃতিগুলোকে তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। ক্রমাগত মাদক গ্রহণ মস্তিষ্কের ব্যাসালগ্যাংলিয়াকে অতি সক্রিয় করে। ব্যাসালগ্যাংলিয়ার অতি সক্রিয়তা মাদক গ্রহণকে একটি অভ্যাসে পরিণত করে। যে মাদক গ্রহণ শুরু হয় কৌতূহল ও মানসিক চাপ দূর করার চেষ্টার উপাদান হিসেবে, তা শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয় যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একসময় দুরুহ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে পূর্ব থেকে প্রচলিত মারিজুয়ানা, হেরোইন, ফেন্সিডিলের সাথে সাথে বিগত দশকে মেথএম্ফেটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রনে তৈরী ইয়াবা নামের একটি মাদকও সহজলভ্য হয়েছে। এর মধ্যে ইয়াবার উত্থানে আমরা দেখি, অপেক্ষাকৃত তীব্র স্টিমুলেন্ট হিসেবে মস্তিষ্কে ইয়াবার প্রভাবকে যা শুরুতে কাজের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর উপায় ভেবেই অনেকে গ্রহণ করে। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও কর্মজীবীদের মাঝে পিয়ার প্রেশার, মেথএম্ফেটামিনের প্রভাবে ক্লান্তিহীনভাবে অবিরাম কাজ করার ক্ষমতা। এই উপাদানগুলোই ইয়াবাকে কম সময়ে পরিচিত করেছিল। একই সাথে মাদক পাচারের রুট হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলো ও বাংলাদেশের অবস্থানকেও বিবেচনায় আনা যায়।
মাদক গ্রহণ শরীরের স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন— মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া, সাইকোসিস, উদ্বেগ জনিত সমস্যা, নিদ্রাহীনতা, অস্থিরতা, হতাশা, কর্ম—স্পৃহার অভাব, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি, সিজোফ্রেনিয়া, হার্ট ডিজিজ, হাই ব্লাড প্রেশার, লিভার ও কিডনি ডিজিজ ইত্যাদি। মাদকাসক্তি আইনগত সমস্যা, অর্থনৈতিক ক্ষতির সাথে সাথে ব্যক্তির সামাজিক ও পেশাগত জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা সংস্থার সূত্রের মতে, হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে ১০ শতাংশের রোগী আসক্তি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে বর্হিঃবিভাগগুলো পরিদর্শন করছেন।

ফ্যাশনকে মানুষের আচরণ এবং মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে দেখা যেতে পারে, কারণ এটি আমাদের নিজেদেরকে প্রকাশ করতে, অন্যদের কাছে আমাদের স্বকীয়তা পৌঁছাতে এবং আমাদের মানসিক অবস্থা এবং আত্ম—ধারণাকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে মাদকাসক্তির অনুঘটকগুলোর মধ্য থেকে ফ্যাশনের উপকরণ হিসেবে আচরণ, দক্ষতা, পোশাক, জ্ঞানকে বাদ দিয়ে মাদককে বেছে নেওয়াটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অন্যতম প্রধান একটি অনুঘটক। মাদকের দীর্ঘমেয়াদী কুফলগুলো ফ্যাশনের মূলভাব— যা মানুষকে পরিপূর্ণ বিকশিত হতে সাহায্য করে, তা কখনোই ধারণ করতে পারে না। এ জন্যই থেরাপিস্ট ডোনাল্ড লিন ফ্রস্ট বলেছেন ’’Drugs take you to hell disguised as heaven.’’

লিখেছেন,
ডা. ফাহিম আহসান আল রশিদ

 

Previous articleবিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধকালে কতটা যন্ত্রণাদায়ক হয়?
Next articleকোনো ‘অসংগত আচরণ’ মানসিক রোগ নাকি পারিবারিক বা সামাজিক প্রথা? তা কীভাবে বুঝবো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here