সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব ৯০০০ এর আশেপাশে। পশ্চিম এশিয়ার অর্ধচক্রাকার উর্বর ভূমিতে ঘটে যাওয়া প্রথম কৃষি বিপ্লবের গল্পটা এরকম-ঐ অঞ্চলে তখন এক ধরনের জংলী যব জন্মাত (এই যবই হল মানুষের প্রথম চাষকৃত শস্য) যার নাম আরিয়া (Ariza)। আরিয়ার ক্ষেতে Claviceps Purpurea নামে এক ধরনের আগাছা জন্মাত। মানুষের খাবারে যবের পাশাপাশি সেই আগাছা মেশানো থাকত। যা গ্রহণের পর চিত্তচাঞ্চল্য (Euphoria) ঘটত। এই মানুষগুলো তখন থেকে যাযাবর শিকারীয় জীবন ছেড়ে দিয়ে এক জায়গায় স্থায়ীভাবে আবাস গড়ে জমি কর্ষণ শুরু করল।
Smithsonian Institution তেজষ্ক্রিয় কার্বন ব্যবহার করে এটা নিশ্চিত করেছেন যে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৯০০০৮০০০ আমেরিকার আদিবাসীরা Sephora নামের এক ধরনের মটর (Mescal Bean) ব্যবহার করত। এই বীজে Sophorin নামক অ্যালকলয়েড আছে যা চেতনানাশক (Narcotics) এবং মায়া বা ভ্রম উৎপাদক (Hallucinogen)। প্রায় একই সময়ে তাইওয়ানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনে গাঁজা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু মাদক ব্যবহারের ধারাবাহিক ইতিহাস অনুসন্ধান করলে আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। যেমন- বিবর্তনের তত্ত্বানুসারে, নরবানর (Ape) থেকে Homo Sapiens বা শারীরিক কাঠামো অনুযায়ী আধুনিক মানুষে রূপান্তর হয়েছিল ১-২ মিলিয়ন বছর আগে, আফ্রিকায়; সেখান থেকে Homo Sapiens পরবর্তীতে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এটাকে বলে আফ্রিকা ত্যাগ তত্ত্ব বা Out of Africa Hypothesis।
মানুষের এই রূপান্তর হয়েছিল নাকি তাদের খাদ্যে Psychedelic এর অন্তর্ভুক্তির পর। ইরাকের সানিদার গুহায় (Shanidar Cave) নিয়ান্ডারথালদের সংস্কৃতির যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে এটা প্রতীয়মান হয়, তাদের জড়িবুটি (Medicinal Plant) বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ছিল এবং এই ধরনের বিশেষ উদ্ভিদ তারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও শামান (Shaman) গুরুদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ও কবরে ব্যবহার করত। অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীবৃন্দ Pituri নামক মিশ্রণ আহার করতেন যেটা এক ধরনের (Stimulant) বা উত্তেজক।এই মিশ্রনের ব্যবহার এখনো প্রচলিত। এটা অদ্যাবধি সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী ব্যবহৃত মাদক দ্রব্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে প্রথম মাদক বিপ্লব (মতান্তরে প্রথম ঔষধ বিপ্লব বা First Drug revolution) সংঘটিত হয় শামানদের মাধ্যমে এশিয়াতে। শামানগণ এ পর্যায়ে Cannabis বা গাঁজার কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ও ব্যবহার (Recreational Use) শুরু করেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য উদ্ভিদজাত মাদকের আবিষ্কার ও ব্যবহার ক্রমান্বয়ে হতে থাকে এবং দ্রুত তা আফ্রিকা, ইউরোপ ও সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পপি চাষ হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। দক্ষিণ স্পেনে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের সমসাময়িক যে কবর আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে মৃতদেহের সাথে বর্তুলাকার থলে পাওয়া গেছে তার ভেতর আফিমের বড়ি (Opium Capsule) ছিল। একই সময়ে মেসোপটিমিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তের মানুষের মধ্যে অ্যালকোহল বা মদের ব্যবহার শুরু হয়। তার একহাজার বছর পরে খ্রিষ্টপূর্র্ব ৩০০ অব্দে চীন দেশে Ephedra Sinica নামে এক ধরনের উত্তেজকের ব্যবহার শুরু হয় যা দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করত। এই সময়টাতে চীনালিপির উদ্ভব হয়। একই সময়ে আমেরিকার চামুস ইন্ডিয়ানদের (Chamush Indian) যে দেয়ালচিত্র (Murals) পাওয়া যায় তাতে এটা স্পষ্ট যে, তাদের আচারঅনুষ্ঠানে ধুতুরার ব্যবহার ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে চীনা ভাষায় রচিত চিকিৎসা শাস্ত্রের পুস্তকে ঈধহহধনরং বা গাঁজার গুণাগুণ বর্ণিত হয়েছে। ঐ সময়ে ম্যলেরিয়া, বেরিবেরি, বাতের ব্যথা, মানসিক বৈকল্য এবং স্ত্রী রোগে গাঁজার ব্যবহার নির্দেশিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি সোমরস বা Cannabis পায়ী আর্যগণ ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন। সোমরসের প্রস্তুতপ্রণালী এবং এর উপাদান সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত হলো-এটি প্রস্তুত হতো মধু এবং বিভিন্ন জড়িবুটির রস দিয়ে। যা অ্যালকালয়েড ধরনের এবং চেতনাবিনাশক ও বিভ্রম সৃষ্টিকারী পর্দাথের মিশ্রণ। এই সোমরস এর বিবরণ বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে। অপর ঘটনা হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে মদ্যপান করা আন্টালানটিকের তীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষভাগের সমকালীন রুমানিয়ার একটি কবর স্থানে তামার পাত্রের মধ্যে শনের পোড়ানো বীজ পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, লৈাহযুগের এই সময়টাতে সমগ্র ইউরোপে ধর্মীয় আচারে গাঁজা বা শনের ব্যবহার হতো।
২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম Ephedra Sinica থেকে এফিড্রিন নিষ্কাশন করা হয়। চীনারা একে বলত কিনইয়া (Kin Iya) পরবর্তীতে যাকে আরবীয়রা নামকরণ করে কিমিয়া (Kimya) বা আলকিমিয়া বা আলকেমি। এভাবেই জন্ম হয় পশ্চিমা ঔষধ বিজ্ঞান তথা রসায়নের। ২০০০-১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ আমেরিকার (গুয়েতেমালা) মায়া সভ্যতায় Psychedelic বা চেতনানাশক ছত্রাকের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। এভাবেই ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পররাষ্ট্রবাদের ধর্মগ্রন্থ জেন্দাবেস্তা (Zend-Avesta)-তে এক ধরনের রজনের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সম্ভবত হাশিশ। এই সময়কার ভারতীয় চিকিৎসক শুশ্রুতা কুষ্ঠরোগের চিকিৎসায় গাঁজার ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শুশ্রুতা শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেদনানাশক হিসেবে মদ এবং গাঁজার যৌথ ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন তাঁর লেখা শুশ্রুতা সংহিতা পুস্তকে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে আচার-আনুষ্ঠানিকভাবে গাঁজা সেবন শুরু হয় ভারতবর্ষে। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী গাঁজা মানবজাতির জন্য শিবের আর্শীবাদ স্বরূপ। তখন থেকে ভারতীয় চিকিৎসকগণ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এবং শৈবগণ ধর্মীয় আচার হিসেবে গাঁজার ব্যবহার শুরু করেন। মানুষের বিকাশের সাথে সাথে মাদকের ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একে বিকাশের অন্যতম প্রভাবক বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু প্রাচীন যুগে মাদকের ব্যবহার শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার, আধ্যাত্মিকতার চর্চা এবং রোগের চিকিৎসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করা হয়। এটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য অভ্যাস ও এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত ছিল বলেই ধারণা করা হয়। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা এখনকার মতো সেই সময়ে সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।
সূত্র: মনের খবর, মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন