মাদকাসক্তি বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা। শুধু কিশোর-তরুনই নয়, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাও মুক্ত নয় মাদকের আগ্রাসন থেকে। অন্যদিকে দিনে দিনে ভেঙ্গে যাচ্ছে যৌথ পরিবার কাঠামো। হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক অভিভাবকত্বের প্রথা। এই সুযোগে আনাচে কানাচে বেপরোয়াভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। বিড়ি-সিগারেটসহ কোনো প্রকার তামাক সেবনকে মাদক হিসেবেই মনে করেন না সাধারণ জনগণ। অথবা তারা মনে করেন এগুলো কম ক্ষতিকর। কেউ কেউ মদ্যপানকে আধুিনকতার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কোনো কোনো শিল্পী মাদক গ্রহণকে সৃষ্টিশীলতার প্রধান উপকরণ মনে করেন। আর তাঁদেরকে দেখে, কখনো কখনো নাটক-সিনেমায় মাদকের ভুল উপস্থাপনে উৎসাহিত হয়ে তরুণেরা ঝুঁকে পড়ে মাদকে। বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে, কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে অথবা কেবলই নিজেকে একজন ‘স্মার্ট’ হিসেবে তুলে ধরতেও মাদকের পথে পা বাড়াচ্ছে কোনো কোনো কিশোর-তরুণ-তরুণী। ধীরে ধীরে, অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে আসক্ত। আক্রান্ত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি রোগে।
এভাবেই মাদকের ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় আগামী প্রজন্ম। ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং গোটা জাতি। মাদকাসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে দেখার পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর ভয়াবহতা অনুভব করা একান্তই প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় পর্যায়ে মাদক ও মাদকাসক্তির কুফল, পেছনের কারণ ও সমাধানের জন্য করণীয় নিয়ে ‘মনের খবর’ মাসিক ম্যাগাজিনের মনো-সামাজিক বিশ্লেষণ বিভাগে কথা বলেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার ব্যক্তিবর্গ। যেটি সংকলন করেন- ডা. পঞ্চানন আচার্য্য, সহযোগিতায় ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ এর অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদুর রহমান এর অভিমতটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল-
[int-intro]অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদুর রহমান[/int-intro] মাদক ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক উভয় শক্তিই নষ্ট করে দেয়। যে শক্তিটা আসলে পারিবারিক বা সামাজিক কোনো না কোনো কাজে লাগতো। ফলে তার উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। তার থেকে সমাজের পাওনা কেবলই শূন্য। যে পরিবার থেকে কোনো ব্যক্তি মাদকাসক্ত হচ্ছে, সেই পরিবারেরও অবশ্যই দায় আছে। তাই কেবল ব্যক্তির নয়, পুরো পরিবারকেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। পরিবারের ভিতরে আসলে কী হচ্ছে, পারিবারিক সম্পর্কের সুষ্ঠ বিকাশ ঠিক কতটুকু ঘটছে, সেটা নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। নিজের কোনো সংকট থেকে বাচাঁর জন্যই হয়তো সে মাদক গ্রহণ করছে।
একটি বিষয় এখানে বলতে হচ্ছে, সমাজকে শুধুই একটি চাপ সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ব্যক্তি অনেকাংশে অসহায় সমাজের কাছে। সমাজ যদি সহায়ক হতে পারে, তাহলে ব্যক্তির জন্য উপকার হয়। আর সমাজ চাপ সৃষ্টিকারী হলে ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। এদের সম্পর্ক হবে সহায়তার, পরষ্পরের সাথে খোলাখুলি সম্পর্ক থাকবে। এই জায়গাটাতে কমিউনিটি সাইকোলজির একটা ভূমিকা আছে। কমিউনিটি সাইকোলজি ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির অথবা ব্যক্তির সাথে সমাজের বৈষম্যমলূক সম্পর্ক তৈরি হলে তা নিরসনে কাজ করে। একটা সমাজের অন্তর্ভুক্ত লোকদের আন্তঃসম্পর্কের যে মিথস্ক্রিয়া, তা বাড়ানোর মাধ্যমে পুরো সমাজকে মানসিকভাবে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে।
মাদকাসক্তির সমস্যাটা আসলেই বহুমাত্রিক। এই মাদক দূর করতে কোনো প্রতিষ্ঠান একা কিছুই করতে পারে না। কেউ মাদক নিচ্ছে মানে এই নয় যে, তাকে গিয়ে অপমান করা যাবে। বরং সে কেন মাদক নিচ্ছে সেটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। মাদক যেন সহজলভ্য না হয়, এর জন্য সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থাও করতে হবে। স্কুলকে এখন ফলাফল তৈরির কারখানা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেটা আসলে হওয়ার কথা নয়। স্কুল হবে একই সাথে শিক্ষা ও বিনোদনের একটি জায়গা। সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন প্রত্যেকটিকে নিজের দায়ভার পালন করে সুস্থ সমাজের জন্য সহায়ক হওয়া আবশ্যক। সমাজ সুস্থ না হলে তার ভিতরের ব্যক্তিরা সুস্থ থাকতে পারে না। ঘুরিফিরে বাবা-মার কথা আসবেই, তারাই সন্তানের সুস্থ মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করবে। তবেই গড়ে উঠবে সুস্থ দেহ, সুন্দর মনের অধিকারী মাদকমুক্ত আগামী প্রজন্ম, যার হাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে যাবে দেশ, বিশ্ব ও সভ্যতা।