মহামারির সময়ে মানসিক অবস্থা

মহামারির সময়ে মানসিক অবস্থা

এই পৃথিবীর সবকিছুই চলছিল গতানুগতিক নিয়মে। হঠাৎ চীনে দেখা দিল এক নতুন রোগ কোভিড-১৯ বা করোনা, ছড়িয়ে গেল ইউরোপ-আমেরিকা, পার্শ্ববর্তী দেশ হয়ে আমাদের দেশেও। একজন- ‍দুইজন করে বাড়তে থাকল আক্রান্তের হার, সেই সঙ্গে আতঙ্ক।

কী হচ্ছে বা কী হবে-সেটা নিয়ে কেউই যেন কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছে না, কী করণীয়, কোথায় কী সাহায্য পাওয়া যাবে সবই যেন অস্পষ্ট। গণমাধ্যমে একের পর এক নেতিবাচক সব খবর সন্তান-পিতামাতাকে ফেলে যাচ্ছে, মৃতদের কেউ সৎকার করতে আসছে না, চিকিৎসা নেই, হাসপাতালে শয্যা নেই, কোথাও ভর্তি করানোর আপ্রাণ চেষ্টার মধ্যেই ঝরে যাচ্ছে রোগীর প্রাণ, আরো কত কী! সব মিলিয়ে করোনায় শারীরিক সমস্যা হবার আগেই মানসিক অবস্থা বা মানসিক স্বাস্থ্য পড়ে গেল হুমকির মুখে।

আমাদের দেশেই নয় শুধু, সারাবিশ্বেই একই অবস্থা। করোনা সংক্রান্ত যা কিছু মানসিক সমস্যা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে এদের মাত্রা এবং ধরনের মধ্যে ভিন্নতা হয়ে থাকে। এমনি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত হচ্ছে প্রথমত, করোনাকালীন সময় কিন্তু আক্রান্ত নয়; দ্বিতীয়ত, করোনাকালীন সময় কিন্তু আক্রান্ত এবং তৃতীয়ত, করোনা পরবর্তী সময়। সেইসঙ্গে ভিন্নতা হতে পারে করোনা যোদ্ধা বনাম সাধারণ জনগণের মধ্যে।

প্রথমেই আসি করোনাকালীন সময়ে কী কী কারণে মানসিক সমস্যা হতে পারে? করোনা আমাদের কাছে
মহামারি হিসেবেই একটা মানসিক চাপ। সেইসঙ্গে আছে আরো অনেক কারণ। যেমন-স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত, সবসময় একটা আতঙ্ক বা অস্থিরতা, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, সামাজিক বিভিন্ন ভুল ধারণা, করোনা সংক্রান্ত ভীতিকর তথ্যপ্রবাহ।

আগে থেকেই যারা মানসিক সমস্যা বা রোগে আক্রান্ত ছিলেন তাদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। আর যখন কেউ সত্যি সত্যি আক্রান্ত হয়ে যান তখন চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্বেগ, শারীরিক অসুবিধাসহ নানা কারণে এই মানসিক চাপ বেড়ে যায় বহুগুণ। আর এসব থেকে ‍সৃষ্টি হতে পারে বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ, স্ট্রেস সম্পর্কিত রোগ, অনিদ্রাজনিত রোগ। হঠাৎ করে হতে পারে প্যানিক অ্যাটাক বা প্যানিক ডিজঅর্ডার। বেড়ে যেতে পারে মাদকাসক্তি সম্পর্কিত সমস্যা। যারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়  ‍ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের সমস্যা, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, সংজ্ঞা হারানো, সাইকোসিস প্রভৃতি। বাচ্চাদের মধ্যে প্রধানত হয় দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতাসহ বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা।

চিকিৎসকসহ যারা করোনা সম্পর্কিত কাজে জড়িত তাদের মধ্যে পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হবার
সম্ভাবনা থাকে বেশি। অন্যদিকে, করোনাকালীন মানসিক সমস্যার চেয়ে করোনা পরবর্তী মানসিক সমস্যা কিন্তু অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এখন সমাধান কী? এককথায় যদি বলতে চাই, তবে বলব ‘Accept & Ignore’ এর কথা। মানে মেনে নেয়া এবং তারপর সেটাকে সরিয়ে রাখা। এই সময়ে দুশ্চিন্তা, ভয়, হতাশা লাগবেই। এটার জন্য নিজেকে অক্ষম, দুর্বল বা অন্য কিছু ভাবার কিছুই নেই। তাই এটাকে যদি স্বাভাবিক হিসেবেই জানি এবং মানি, সেটা আর বেশি চাপ তৈরি করবে না। এরপরের ধাপ হচ্ছে এটাকে মোকাবেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। সেটা কীভাবে?

কোনো বিষয়ে আমাদের ভয়, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ তৈরি হয় বিষয়টা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা জানাশোনা যদি কম থাকে। তাই, প্রথমেই বলব করোনা বিষয়ে তথ্য জানার কথা। কিন্তু সেখানে লাগাম
টানার একটা বিষয় আছে। কোথা থেকে জানব, কতটুকু জানব, কোন তথ্যকে মানব সেগুলোও খেয়াল রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নয়, একজন বিশেষজ্ঞ থেকে।
হুজুগে গা না ভাসিয়ে বিশেষজ্ঞ কে সেটাই আগে আমাদের বুঝতে হবে। আবার করোনায় কোন ঔষধটা খেতে হবে সেটা জানার চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি, চিকিৎসাপ্রাপ্তির স্থান, টেলিফোনে কারা সেবা দিচ্ছেন, করোনার লক্ষণ দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে কী করণীয় এই সবে বেশি নজর দেয়া দরকারি। কোভিডের খবরে কতজন আজকে মারা গেল তার চেয়ে কতজন ‍সুস্থ হল সেটার দিকে বেশি গুরুত্ব দেব। কারণ বাস্তবেই করোনায় মৃত্যুর চেয়ে সুস্থ হওয়ার হার বেশি।

একইভাবে করোনায় আক্রান্ত হলে প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে প্রিয়জনের পাশে থাকা মানুষের সংখ্যা বেশি সেটা বুঝতে হবে। আবার সারাদিন করোনা নিয়ে তথ্য ঘাঁটাঘাঁটির দরকার নেই। আমি আমাকে নিরাপদ রাখা ছাড়া করোনায় আর কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না-এটা মেনে নেব। আমার নিয়ন্ত্রণে আছে আমাকে বা আমার পরিবারকে নিরাপদ রাখার জন্য কারণ ছাড়া বাইরে না যাওয়া, বাইরে গেলে শারীরিক ‍দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা প্রভৃতি।

দ্বিতীয়ত, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন। করোনার জন্য সবারই স্বাভাবিক জীবনযাপনটা কোনো না কোনোভাবে পরিবর্তন হয়েছেই যার সঙ্গে সঠিকভাবে অভ্যস্ত হতে হবে। স্কুল-কলেজ নেই বলে সারাদিন গেইম খেলা বা দেরি করে  ‍ঘুমানো এবং ওঠা, এসব বদভ্যাস গড়ে উঠতে না দিয়ে আগের নিয়মেই আমরা ঘুমোতে যাব, ঘুম থেকে উঠব। খেয়াল করলেই দেখব, বাইরে যাওয়ার সময়টা ছাড়া অন্য সময়গুলো কিন্তু ঠিক আগের মতোই আছে। এই সময়টাকে অন্য কোনো বিষয় দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। যেমন: বই পড়া, গল্প করা, গান শোনা, নাটক সিনেমা দেখা, ধর্মকর্ম করা, পরিবারের সদস্যাদের সঙ্গে সময় কাটানো, ঘরের বিভিন্ন কাজ করা, এতদিন সময়ের অভাবে যে কাজগুলো করা হয়ে উঠছিল না সেগুলো করা। আর পরিমিত খাবারদাবার-ঘুম-বিশ্রাম, শারীরিক ব্যায়াম এগুলো চালিয়ে যেতে হবে। নেশাজাতীয় জিনিসসহ অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে। প্রতিদিন কিছু সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটাতে হবে, আমরা বলি কোয়ালিটি টাইম, ফোন বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরে থাকা কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলা, এসব করতে হবে। তাতে মনের একঘেয়েমি কেটে যাবে, একাকী লাগবে না।

আপনি যদি আগে থেকেই সঠিক ধারণা নিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন তবে করোনার লক্ষণ দেখা দিলে আপনার মানসিকভাবে শক্ত থাকাটা সহজ। বাস্তবে যদি শক্ত থাকতে না পারেন, তবে আতঙ্কিত হবেন না। জেনে রাখুন করোনার যে উপসর্গ বা লক্ষণ এগুলো সাধারণ কোনো ফ্লুতে বা অন্য কোনো রোগের কারণে বা মানসিক সমস্যা থেকেও হতে পারে। তাই প্রথমে একজন নিকটস্থ এমবিবিএস চিকিৎসক বা অনলাইনে দেওয়া কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। আর করোনা পরীক্ষার রিপোর্টে পজিটিভ আসলে ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই, এটা মনে রাখতে হবে।

কারণ আগেই বলেছি করোনা হলে সুস্থ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আবারো ‘Accept & Ignore’। প্রথমে মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং নিজেকে শারীরিকভাবে আলাদা করে রাখতে হবে। এটা আপনার তাড়াতাড়ি ভালো হওয়া এবং প্রিয়জনদেরকে আক্রান্ত না করার ব্যবস্থা। এটা লজ্জা নয়, আপনাকে কম ভালোবাসা বা দূরে ঠেলে দেয়া নয়। এরকম অনেক নেতিবাচক চিন্তা মনে আসতে পারে যা বাস্তবে নিজেকে কষ্ট দেয়া ছাড়া আর কোনো লাভ বয়ে আনে না। তাই মনকে নিশ্চিন্ত রাখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিন, আপনার ভালোলাগার বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন। আগে সেরকম অভ্যাস না থাকলে এখন থেকে শুরু করুন, অভ্যাস হয়ে যাবে।

এছাড়া, কিছু রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ করতে পারেন। সহজ ব্যায়ামটা হলো নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়া
আর মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়া। এটা একটানা পাঁচ মিনিট ধরে করা। আরো জানতে চাইলে ইউটিউবে একটু সার্চ করলেই অনেক অনেক ভিডিও দেখতে পাবেন।

সবশেষে বলব, মন যদি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, বা মানসিক সমস্যাতে কষ্ট পাচ্ছেন বেশি এমন হয় তাহলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) বা মনোবিজ্ঞানীর (সাইকোলজিস্ট) পরামর্শ নিন অনলাইনে অনেকের নম্বর পাবেন। সমস্যা বেশি বা জটিল হলে সরাসরি হাসপাতালে চলে যাবেন। এখানে লজ্জার কিছু নেই, ভয়ের কিছু নেই। আর করোনা নিয়ে সামাজিক অজ্ঞতা বা ভুল ধারণা থেকে নিজেও বেরিয়ে আসুন, অন্যকেও বের করে আনুন। সবাই ভালো থাকুন।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous article“আত্মার বিলাপ” অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল এর নতুন বই
Next articleমহামারীর এই দুঃসময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রভাব
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here