এক.
কিছু কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ অনেক সময় মাথা ঘোরানো, ঝিমঝিম, ভালো না লাগা, চুপচাপ বসে থাকা অথবা হঠাৎ মেজাজ চড়ে যাওয়া, মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, উধাও হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো নিয়ে মানসিক রোগীরা দীর্ঘদিন ভোগে থাকেন। এখানে ওখানে, এ ডাক্তার ও ডাক্তার, কবিরাজ, ভন্ডপীর, আংটি, পাথর সব খানেই দিনের পর দিন অপচিকিৎসার শিকার হন। খুব কম ক্ষেত্রেই মানসিক রোগের এসব লক্ষন নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে আসেন।
সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোটা আমাদের সোসাইটিতে এখোনও সেই আদিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারনাতেই রয়েছে। আবার অনেকে আছেন এগুলো যে মানসিক বা সাইকিয়াট্রিক রোগের লক্ষ্মণ সেটা জানেনই না। আর তাই এ ঔষধ, সে ঔষধ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি দিয়ে অপচিকিৎসা করেন। রোগীর সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেন। আজকে তেমন এক রোগীর কাহিনী…..
অনামিকা (ছদ্মনাম) যখন সবে ক্লাস এইটে তখনই হঠাৎ শুরু আসে বিয়ের আলাপ। সুদর্শন সু’পাত্র, সোনায় সোহাগা। বিদেশী সিটিজেনশিপ ওয়ালা। বিয়ের পর বিদেশে সেটেল্ড, সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
সবাই রাজী। সবার গাল গল্প আর ঠাট্টা রসে অনামিকাও না বুঝে রাজী হয়ে যায়। মহা ধুমধামে বিয়ে হয় অনামিকার। বিয়ের সকল খরচ বহন করে বিদেশি পাত্র। তাদের টাকার অভাব নেই।
বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই পাত্রের মা বাবা ভাই বোন বন্ধু বান্ধব সবাই এক ফ্লাইটে চলে যায়। ফ্লাইটের দুই তৃতীয়াংশ যাত্রী কেবল তারাই। পাত্র থেকে আরো দুই সপ্তাহ। সে বিয়ের কথা বলে ছুটি’টা একটু বাড়িয়েই এনেছে।
চোখের পলকেই কেটে যায় বাকি দুটা সপ্তাহ। পাত্র ফুরফুরে মেজাজে যাবার প্রস্তুতি নেয় তার আপন গন্তব্যে।
এয়ারপোর্টে বিদেয় দেবার সময় অনামিকা আড়ালে স্বামীকে ডেকে নিয়ে বলে, দুদিন যাবৎ তার শরীর কেমন কেমন লাগে, জ্বর জর ভাব। খাবার অরুচি, খেতে বসলেই বমি আসে। অনামিকার স্বামীর চোখ চক চক করে উঠে। চিৎকার করে বললো, ” ইয়া হু….কি বললা, আমাকে আগে বলবানা আমায়?!
স্বামী যাবার পর একাএকা অনামিকার কিছুই ভালো লাগেনা। কটা দিন যেনো স্বপ্নের মধ্যেই ছিলো। স্কুলের পড়াশোনাও আর ভালো লাগেনা। তার পাসপোর্ট তৈরির কাজ চলতে থাকে। সব কিছুই ঠিকঠাক ভাবে এগোয়। অনামিকা তার দেহে প্রানের অস্তিত্ব টের পায়। সে তার সাথে কথা বলে আনমনে।
হঠাৎ এক দুঃসংবাদ অনামিকার জীবনের সকল স্বপ্ন আশা ভরসা কেড়ে নেয়। কাজে যাবার পথে বিদেশে তার স্বামী রোড এক্সিডেন্ট এ মারা যায়।
তার পরের ঘটনা গুলো আরো ভয়াবহ। প্রথমে শ্বশুর বাড়ির পক্ষের লোকজন পরে নিজের মা বাবা পরামর্শ দেয় বাচ্চা নষ্ট করে ফেলার। কারন অন্ধকার পথে না হাঠাই ভালো। অনামিকা রাজি হয়না।
সেই বাচ্চার বয়স এখন চার বছর। স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে কেবল। অনামিকা বাবার বাড়িতে থাকে আবার স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুল শেষ করে এখন কলেজে। সংসার পড়ালেখা বাচ্চার লালন পালন এসব খরচ বিদেশ থেকে শাশুড়ী পাঠান। যৎসামান্য হলেও তা দিয়ে চলে যাচ্ছে।
মন খারাপ, মাথা ব্যাথা, ঝিমুনি, ঘুম কম হওয়া, পড়াশোনা কাজ কর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মুলত এসব নিয়েই সাইকিয়াট্রিস্ট এর চেম্বারে এসছিলো অনামিকা। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাথে কথা বার্তার এক পর্যায়ে এই করুন কাহিনী বেরিয়ে এলো।
অনামিকার মা জানালেন কি এক রহস্যময় কারনে শ্বাশুড়ি অনামিকা বা তার মেয়েকে বিলেত নিতে চাইছেন না। তিনি অনামিকাকে দ্বিতীয় বিয়ের ও অনুমতি দিচ্ছেন না। অনামিকাকে না হোক তার মেয়ে সেটাতো তার রক্তেরই বন্ধন একেও বিলেত নেবার আগ্রহী নন শ্বশুর শাশুড়ী কেউ। মেয়েটার জীবন এক অনিশ্চয়তার পথে হাটছে আজ দুতিন বছর যাবৎ।
অনামিকার সামনেই তার মা বললেন, “আমরা এখন কি করবো বুঝতে পারছিনা। রোজ তার বিয়ের আলাপ আসে। ভালো মন্দ,সব। সবাই সব কিছু জেনে শুনেই আসে। দেখুন আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে। কয়টা মেয়ে আছে তার মতো এমন। আর কেউ বলবে, ওর বিয়ে হয়েছে বাচ্চা আছে? শ্বশুর পক্ষের লোকরা এখন বলেছে, সে যদি এখন দ্বিতীয় বিয়ে করে তাহলে তারা তাকে আর কোন খরচপত্র দিবেনা। এমন কি অনামিকাকে বা তাদের নাতনি কে বিলেত নিয়ে সেটেল্ড করবে সেটাও হবেনা । আমরা কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা।
মেয়ের সারাজীবন পড়েই রইলো। বয়স আর কতই বা হলো, সবে আঠারো কি উনিশ। ভালোর জন্যেই সব করা কিন্তু কথা থেকে কি হয়ে গেলো। স্যার, কি করবো এখন? আমি মা। আমি মা, আমি বুঝি আসলে মেয়ের অসুখ কি?
দুই.
অনামিকা কে একা ডেকে জিগ্যেস করলাম, তুমি কি চাও।
“স্যার আমার দ্বিতীয় বিয়েতে কোন অসুবিধা নেই। আমিও মনে করি আমার বিয়ে করা উচিৎ আজ বা কাল। কিন্তু ওরা বলেছে আমি যদি বিয়ে করি তাহলে তারা কখনোই আমার মেয়েকে বিলেতে নেবেনা। এমন কি আমার মেয়ের কোন খরচ পাতিও তারা আর দেবেনা, আমি আমার মেয়ে কি অপরাধ করলাম?”, অনামিকার চোখে জ্বল।
“দেখুন এখানে কান্নার বা মন খারাপের কিছু আমি দেখিনা। ভাগ্যকে মেনে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হয়। আমি আপনার বা আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন সমস্যা দেখছিনা। আপনারা যে রকম ভাবছেন সে রকম না। সে তার বাবার দেশে যেতে পারবে৷ এটা আইনের ব্যাপার। এরকম অনেক ঘটে। আপনাকে তার জন্যে একটু আইনের আশ্রয় নিতে হবে। সলিসিটর এর শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি আপনার মেয়ের সুন্দর সমাধান করবে। সব অধিকার নিশ্চিত করবেন।
আর আপনার সমস্যার সমাধান আপনিতো করছেনই। আপনি আপনাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। ক’জন এমন পারে, বলুন?
আমার মতে আপনি আলোর পথেই হাটছেন। আপনি কলেজে ভর্তি হয়েছেন, পড়াশোনা শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন”
“জ্বী স্যার। I want to smile.”
“That’s Good.”
“স্যার আমার মাথা ব্যাথা বা আর এই যে অজ্ঞান হয়ে যাই এগুলোর কোন ঔষধ লাগবেনা?”
“না, তার আর দরকার আছে বলে মনে করিনা। এসব তখন হয় যখন আপনি অতীত নিয়ে ঘাটেন। বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। এগুলো মেন্টাল কনফ্লিক্ট এর ফিজিক্যাল সিমটম।”
“স্যার, বুঝিনি!”
“মানে আপনার মনের গহীনে জমে থাকা কষ্টগুলোর শারীরিক বহিঃপ্রকাশ।”
অনামিকা ছোট একটা হাসি দিয়ে বললো, “স্যার আপনি আমাকে অনেক ভারমুক্ত করলেন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন”।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন