মনেও পড়ে বয়সের ভার

মনেও পড়ে বয়সের ভার

যৌবনের উচ্ছলতা, চঞ্চলতা শেষে আসে বার্ধক্য। জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যৌবনের এই অপরিপক্ক মানুষগুলোই পরিপক্ক হয় বার্ধক্যে এসে। এই পরিপক্কতা জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, বিবেচনা আর অভিজ্ঞতায়। এই পথ চলতে গিয়ে শরীর হারিয়ে ফেলে তার পূর্বের সেই জীবনীশক্তি। মনটিও তাই প্রায়ই বেঁকে বসে একইসঙ্গে। কারণ শরীর ও মন যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শরীরের ভারে মনটিও তাই মাঝে মাঝে নুয়ে পড়ে এই সময়। শুধু তাই নয়, ক্লান্তিকর এই যাত্রায় জীবনের নানা জটিল সমীকরণ মিটিয়ে বিশ্রাম খোঁজা মন কিন্তু আগের মতো সেই জোরটি খুঁজে পায় না। মনের রোগগুলো তাই বাসা বাঁধতে থাকে খুব সহজেই।

বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৭১ সেখানে গড় আয়ুতে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ২০১৬ সালে যেখানে গড় আয়ু ছিল ৭১.৬ বছর, ২০১৭ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ বছরে। গড় আয়ু বাড়ছে মানে প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে। সারা বিশ্বে ৬১৭ মিলিয়ন মানুষ প্রবীণ যা বিশ্বের জনসংখ্যার ৮.৫ ভাগ। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১.৬ বিলিয়ন। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে এসে দেখা গেছে ৬৫ বছরের ওপরে বয়স্ক মানুষ জনসংখ্যার ৬.২৩ ভাগ। দিনে দিনে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতিতে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ফলে সারা বিশ্বেই বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাই প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত দিকটি শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হচ্ছে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরে ঘটে নানা পরিবর্তন। স্মৃতিশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি-এ তিন প্রয়োজনীয় শক্তি বার্ধক্যে হ্রাস পায়। কিডনি ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হ্রাস পায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। রক্তনালী সরু হয়ে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সম্ভবনা দেখা দেয়। বৃদ্ধ বয়সে পাঁজরের হাড়গুলো কঠিন ও পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ফুসফুসের ক্ষমতাও লোপ পেতে থাকে আর তাই এ সময় ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া ও যক্ষার প্রকোপ বয়স্কদের নিয়মিত সমস্যা হিসেবে দেখা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে হজম ক্ষমতাও অনেক লোপ পায়। শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি থেকে ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। শান্তির ঘুমেও নিত্যদিন ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। নানা ধরনের শারীরিক ব্যথা, বারবার প্রস্রাব হওয়া, শ্বাসকষ্ট, গলা জ্বলা ছাড়াও স্লিপ সাইকেলের পরিবর্তন ঘুমের সমস্যার মূল কারণ। শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা যায় এ সময়। ফলে নানবিধ বাত-ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়, ফলে ক্যান্সার দেখা দেয়।

দীর্ঘমেয়াদি এসব শারীরিক সমস্যা একসময় মনের রোগের জন্ম দেয়। বিশেষ করে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার একটি কারণ এটি। বার্ধক্যে মানুষের বিষাদগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বয়সকালে অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না এবং বয়স্কদের অনেকই এসব উপসর্গের কথা আত্মীয়স্বজনকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। ফলে বিষয়টি সবার নজর এড়িয়ে যায় এবং এ রোগের চিকিৎসাও পিছিয়ে যায়। সমস্যা বাড়তে থাকায় একসময়ে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য হন অনেক বয়স্কই। বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক অসুখ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে। স্ট্রোকের পরে ৫০ থেকে ৭০ ভাগ রোগীর বিষণ্ণতা হতে পারে। হৃদরোগের পরেও বিষণ্ণতার মাত্রা অনেক বেশি। আবার বৃদ্ধ বয়সে নানারকম শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ঔষধ খেতে হয়, যা সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও বিষণ্ণতা হতে পারে বা বেড়ে যেতে পারে। এ বয়সে আবার নানা দুশ্চিন্তাও বাসা বাঁধে। বিশেষ করে যেকোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হতে থাকে। ফলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা রোগ আকারে দেখা দেয় এবং এই বয়সে এর মাত্রা প্রায় ৩.৮ ভাগ।

বার্ধক্যে মস্তিষ্ক শুকিয়ে ছোট হয়ে আসে। একে ডিমেনশিয়া বলে। বিশ্বে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ এতে আক্রান্ত। এতে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং তার স্মৃতিশক্তি কমে যায়; বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি ও চিন্তাশক্তিতে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বৃদ্ধ বয়সে প্রায় ৫ ভাগ ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়া দেখা গেছে। সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো জটিল মানসিক রোগগুলো এই বয়সে হওয়ার সম্ভবনা কম থাকলেও ডিল্যুসনাল ডিজঅর্ডার বা সন্দেহ করা রোগ বেশি বয়সে শুরু হতে পারে। বৃদ্ধ বয়সে অন্যান্য নেশা কম হলেও অনেকে আবার ঘুমের ঔষধে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের প্রবীণেরা সন্তান ও আপনজনের সান্নিধ্যে থাকতে চান। শেষ বয়সে নিজ সন্তানের সেবা আশা করেন। কিন্তু শিল্পায়ন, নগরায়ন আমাদের পারিবারিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট ছোট নিউক্লিয়ার পরিবার গঠন হচ্ছে, ফলে দেশের বয়স্ক মানুষেরা নানা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। সুসংগঠিত সামাজিক সহায়তা না থাকায় তাঁরা অসহায় হয়ে পড়ছেন এবং সংসারের এই নতুন নিয়মে তাদের মানিয়ে নিতেও কষ্ট হচ্ছে যাকে বলা হয় অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার।
এই বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যাগুলো ১৫ ভাগ প্রবীণের মধ্যে দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, বিষণ্ণতা ও ডিমেনশিয়া। বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক কারণও প্রবীণদের মন এবং স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। যেমন : একাকিত্ব, ব্যক্তি স্বাধীনতায় ছেদ পড়া, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অফুরন্ত অবসর এবং একঘেয়ে দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলা, সর্বোপরি নিজের আয় না থাকায় আর্থিক বিষয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে মানসিক নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ শারীরিক বা মানসিকভাবে অত্যাচারিতও হয়ে থাকেন। আমাদের সমাজে বয়স্কদের অবহেলা খুব একটা কমও নয়। ৬ জনের মধ্যে ১ জন কোনো না কোনো অবহেলা বা নির্যাতনের শিকার হন। এই কারণগুলোও বয়স্কদের সার্বিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

যাদের হাত ধরে আজ আমরা নতুনের জয়গান গেয়ে চলেছি তাদেরকে যেন অবহেলার শিকার না হতে হয় তা দেখার দায়িত্ব আপনার, আমার সবারই। ২০১৬ সালে তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হাতে নিয়েছে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা। আমাদের দেশেও চালু হয়েছে বয়স্কদের জন্য সুরক্ষা আইন। এই বয়সের শারীরিক অক্ষমতা, পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা যেন তাদের মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ না করে তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকেই।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleবিষণ্ণ সঙ্গীর কারণে আপনিও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারেন: গবেষণা
Next articleঘুমালে দেখি ভয়ংকর চেহারার কেউ আমার গলা চেপে ধরছে
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here