সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহিদ
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট
সহকারী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল
একটু ভেবে দেখুন তো এক সপ্তাহ আগে পরিচিত হলেন একজন মানুষের সঙ্গে, অনেকক্ষণ তার সঙ্গে খোশগল্পও করলেন, একসঙ্গে চা-নাশতাও খেলেন অথচ এক সপ্তাহ পর যখন তার সঙ্গে দেখা হলো তখন তার নামটাই গেলেন ভুলে। এ রকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে অনেকেই অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ছেন এই ভেবে যে, তার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অনেকে এই আতঙ্কে আবার জানা জিনিসও মনে করতে পারছেন না কিংবা তথ্য স্মৃতিতে সংগ্রহণ করার আগেই ভাবছেন আমি তো মনে রাখতে পারি না আবার ভুলে যাব না তো? যার ফলে কেউ লেখাপড়া, কর্মজীবন এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন।
ধরা যাক সারারাত পড়ার পর পরীক্ষার হলে লিখতে গিয়ে কিংবা মৌখিকভাবে বলতে গিয়ে যদি মনে করতে না পারি কিংবা ভুলে যাই তাহলে তা কতটাই না বিপজ্জনক হতে পারে। আর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে সঙ্গীর জন্মদিনের তারিখটি ভুলে গেলেন কিংবা বিবাহবার্ষিকীর দিন, সে ক্ষেত্রে সঙ্গীর মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে দেবেন যে, আপনার তার প্রতি কোনো আন্তরিকতাই নেই।
তারপর দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সরবরাহ করার কথাও যদি ভুলে যান, তাহলে তো সম্পর্কের অবস্থা কী হতে পারে বুঝতেই পারছেন। এসব থেকে আমরা এটুকু অনুধাবন করতে পারি, ভুলে যাওয়ার অনেক অপকারিতা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো কেন আমরা ভুলে যাই? যে আতঙ্কে অনেকে ভোগেন তা হলো, আমার কোনো রোগ হলো কিনা?
হ্যাঁ, এটা সত্যি যে কোনো কোনো রোগের কারণে আমরা ভুলে যাই যেমন- ডিমেনসিয়া, আলঝেইমার, ডিমিস ইত্যাদি, এছাড়া মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলেও কখনো কখনো ভুলে যাই। এতে এসব কারণ ছাড়াও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও ভুলে যেতে পারে সেসব কারণে আমরা ভুলে যাই, তার মধ্যে চারটি প্রধান বিষয়কে মনোবিজ্ঞানীরা তুলে ধরেছেন:
প্রথমটিকে বলে এনকোডিং, এর অর্থ হচ্ছে ধরুন আপনি কোনো কারণে আপনার স্মৃতিতে তথ্যটি রাখেননি, তাহলে সেটা খুঁজে পাবেন না এবং মনেও করতে পারবেন না। যেমন ধরা যাক তাড়াহুড়ো করে আপনি আপনার নীল রঙের জামাটা আলমারিতে রাখতে গিয়ে অন্য কোথাও রেখে চলে গেলেন। এরপর আপনি পুরো আলমারি যদি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন, তাহলে কোনোভাবেই সেই নীল জামাটি খুঁজে পাবেন না, কারণ আপনি আলমারিতে রাখেননি।
দ্বিতীয় যে কারণে আমরা ভুলে যাই তাহলো ডিকে থিওরি। এর অর্থ হলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো বইয়ের পাতার লেখা যেমন ঝাপসা হয়ে আসে এরপর আর পড়া যায় না, ঠিক তেমনি অনেক আগের স্মৃতি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গিয়ে আমরা ভুলে যাই। তৃতীয় কারণটি হলো Interference Theory। এর মানে হলো একটি তথ্যের উপস্থিতি অন্য তথ্যকে ভুলিয়ে দেয়।
এটি দু’ভাবে হতে পারে। যখন নতুন তথ্যের কারণে পুরনো তথ্য মনে করা যায় না তাকে বলে Retroactive Interference। ধরা যাক একটি অনুষ্ঠানে একজন খুব আকর্ষণীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার কোনো সাক্ষাৎ মনে করে রেখেছে। এরপরই গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় আরেকটি ফোন নম্বর মনে রাখার চেষ্টা করি। এরপর পরেরদিন যখন পুরনো তথ্য অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিগত ফোন নম্বর মনে করার চেষ্টা করি, দেখা যায় পরের নম্বরটি মনে আছে কিন্তু আগেরটি ভুলে গেছি।
ঠিক একইভাবে যখন নতুন তথ্য মনে করার চেষ্টা, সে ক্ষেত্রে পুরনো কোনো তথ্য বাধা দেয়। তখন তাকে Proactive Interference বলে। চতুর্থ যে কারণে সংগৃহীত তথ্যগুলো পুনরুদ্ধার করার কিছু সঙ্কেত থাকে যদি সেই সঠিক সঙ্কেত ব্যবহার করতে ভুলে যাই বা মনে করতে পারি না। যেমন অনেকগুলো শব্দ শিখে আবার মনে করে বলার ক্ষেত্রে যদি শব্দগুলোকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী মনে করার চেষ্টা করি, তাহলে বেশি শব্দ মনে করতে পারবেন এবং ভুলে যাব না যেমন ফল জাতীয় কী কী ছিল, দেশের নাম কী কী ছিল? ইত্যাদি।
এছাড়া আমাদের স্মৃতির ধারণ ক্ষমতা আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করি, সংবেদীয় স্মৃতি, স্বল্প সময়ের স্মৃতি, দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি। সংবেদীয় স্মৃতিতে তথ্য এক সেকেন্ডের বেশি সময় থাকে না, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিতে ১ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে তথ্য হারিয়ে যায়, যদি না তথ্যগুলোকে চর্চার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে না পাঠানো হয়। এতক্ষণ আমি কেন ভুলে যাই বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করলাম, সঙ্গে ভুলে যাওয়ার অপকারিতা
সম্পর্কেও। মানুষ সম্পর্কেও।
মানুষ ব্যস্ত থেকে শুরু করে অসংখ্য তথ্য তার স্মৃতিতে ধারণ করে পরে সবই যদি মনে থাকে এবং কোনোটাই যদি না ভুলে যাই সেটি কতটা সুখকর হবে কখনো ভেবে দেখেছেন কি? অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যের পাশাপাশি অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্যও আমাদের স্মৃতিতে থাকে। এই সবই যদি মনে থাকে তবে কিছু মনে না থাকলে যেমন অসুস্থ লাগে ঠিব সব কিছু মনে থাকলেও একরকম অসুস্থ বোধই হবে।
কারণ অনেক তথ্য খুব নেতিবাচক থাকে, আবার অনেকগুলো থাকে ইতিবাচক। নেতিবাচক স্মৃতিগুলোর সঙ্গে নেতিবাচক স্মৃতিগুলো মনে পড়ে ব্যক্তি ততবারই নেতিবাচক অনুভূতিগুলোও অনুভব করে, যা তাকে অনেক সময় নেতিবাচক কাজের দিকে ধাবিত করতে পারে কিংবা ইতিবাচক কাজ করতে বাধা দিতে পারে।
আমরা দেখি কোনো কোনো মানুষ অতীতের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা কিছুই ভোলে না। অনেক সময় তারা সেটার মধ্যে আটকে যায়। নতুন কিছু করার প্রেরণা পায় না। শুধু তা-ই নয়, যাদের প্রতিটা জিনিস মনে থাকে অনেক সময় তারা না চাইলেও বিভিন্ন জিনিস, সংখ্যা, প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা তাদের মনে থাকে এবং তারা না চাইলেও ইমেজ আকারে দেখতে থাকে যেটা তার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম নিতে দেয় না এবং যেটা অপ্রয়োজনীয় সেটাও মনে করিয়ে দেয়, যেটা তার জন্য অস্বস্তিকর ও বিপজ্জনক।
তাই মাঝে মাঝে অনেক কিছু ভুলে যাওয়াও ভালো। অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার শুধু অপকারিতা নয় উপকারিতাও রয়েছে। আসুন আমরা অপ্রয়োজনীয়, নেতিবাচক বিষয়গুলো ভুলে গিয়ে সুস্থ থাকি, আনন্দে থাকি, তাতে অপকারের চেয়ে উপকারই হবে বেশি।
- এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
- চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
মগবাজার রেইল গেইট।
নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
(ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০ - আরো পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়া শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যে ভালো না খারাপ