অনেক অনেক দিন আগের কথা এক বুক রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো একটি মেয়ে। জীবনের এক নতুন অধ্যায় সূচনার শুভক্ষণে মেয়েটি তার পরম প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেলে। নীল খামে পাঠানো চিঠিতে প্রেমিক ছেলেটি জানায় সম্পর্কটা রাখা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। যাকে নিয়ে সুখের সংসার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্ন ভঙ্গের কারণে মেয়েটি বিষণ্নতায় ভুগেছিলো সুদীর্ঘ বছর। কিন্তু আলোকিত মানুষ হবার স্বপ্ন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তারপরও মাঝে মাঝে সেই কষ্টগুলো তাকে প্রচন্ড আঘাত করে। প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনা সে সইতে পারে না। পারে না ভুলে যেতে।
অন্য আরেকটি কাহিনীতে দেখে যায়, বন্ধু জীবনের সাথে বেশ ক’টা বছর মধুময় দিন অতিবাহিত করেছিলো অনন্যা (ছদ্দনাম)। এক সময় দু’জনেই বুঝতে পেরেছিল এটা নিছক বন্ধুত্ব নয়। এখানে রয়েছে অন্য রকম একটা অন্তরের টান- যাকে বলে ভালোবাসা। তথাপি সাহস করে বলতে পারেনি তোমার সাথেই বাকী জীবনটা কাটাতে চাই। এই ভালোবাসার মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল দু’জনার মধ্যে বিদ্যমান পারিবারিক ব্যবধান। বিত্তশালী জীবনের বাবা-মা কি মেনে নেবে তাদের তাদের এই ভালোবাসাকে! নানা প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে, তাই আর বেশিদূর আগায়নি অনন্যা। একদিন যে দেয়াল ভেঙ্গে আপন করে নিতে পারেনি একে অপরকে অথচ আজ কেন তারই জন্য মন সব সময় কাঁদে? কেন আর অন্য কাউকে স্থান দিতে পারে না এই মন? উচ্চ শিক্ষিত, মেধাবি এক মেয়েটি বিষণ্নতায় ভুগছিলো। মেয়েটি বুঝতে পারে সে এক জায়গায় আটকে গেছে এবং এখান থেকে তার বেড়িয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু পারেনি। তাইতো মনোচিকিৎসায় আসা।
বড়ভাইয়ের মৃত্যুর পরপরই নিদারুণ শুন্যতা থেকে রক্ষা পেতে নেশায় জড়িয়ে পড়েছিলো সবুজ (ছদ্দনাম)। তারপর থেকেই জীবনটা এলোমেলো হয়ে পড়ে তার।
এভাবেই অনেক অনেক তরুণ তরুণী লেখাপড়া করতে পারে না এই বিরহ বেদনার ফলে। এছাড়া নানা ধরণের মানসিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে অনেকে। প্রিয় মানুষকে হারাতে চায়না কেউই। তথাপি এই সত্যের মুখোমুখি হতে হয় অপ্রত্যাশিত ভাবেই। সন্তানের অকাল মৃত্যুতে কষ্টের সাগরে ভাসছে কেউ কেউ। মমতাময়ী মাকে হারিয়ে কি নিদারুণ মনোকষ্টের সৃষ্টি হয় তা ভুক্তভোগীরা সহজেই বুঝতে পারবেন। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে দিশেহারা স্বামী বা স্ত্রী। বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে বিচ্ছেদ, এরপর বিরহের অগ্নি থেকে রক্ষা পেতে মনোচিকিৎসা নিতে হচ্ছে অনেককে।
প্রিয়জন হারানোর ফলে যে সব সমস্যা হয় তা সাধারণত ৬ মাসের মধ্যে চলে যায় বা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে এটি রয়ে গিয়ে তৈরি করে প্রকট মানসিক সমস্যা। অনেক কথা, অনেক ভালোবাসা, শতশত স্মৃতির মেলা কেমন করে ভুলবে মন! কেমন করে কাটবে তার অনাগত দিনগুলো প্রিয় মানুষটিকে ছাড়া! নানা ভাবনা বেদনায় হাহাকার হয়ে উঠে মন। তীব্র কষ্ট, যন্ত্রণায়, শুন্যতায়, মূল্যহীনতায় অপরাধবোধে ভরপুর হয়ে উঠে মনোনদী। কর্মহীনতা, রুচিহীনতা, ওজন কমে যাওয়া, আনন্দহীনতা, কান্না ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। নষ্ট হতে থাকে নিজেকে তৈরি করার মূল্যবান সময়। এই মহা মনোদূর্যোগ মোকাবেলা করতে হিমসিম খেতে হয় তখন। শত চেষ্ট, যুক্তি, জ্ঞান প্রয়োগে শান্ত করা যায় না মনকে।
আসলে এধরণের মনোকষ্টের বোঝা একা বয়ে না বেড়িয়ে বিশ্বস্ত জনকে খুলে বলা প্রয়োজন। ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিচলিত বিষণ্ন মনকে প্রশান্ত করতে কে হতে পারে আপনার সমব্যাথি? আপনার Safe place এ মন খুলে বলে ফেলুন আপনার পুঞ্জীভূত কষ্টগুলো। এতে করে দীর্ঘদিনের চাপ লাঘব হবে। আর যদি মনে হয় এভাবে স্বাভাবিক হতে পারছেন না, তবে শরণাপন্ন হোন মনঃচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলর-এর কাছে। যিনি গুরুত্ব সহকারে আপনার কথা শুনবেন। আপনার কষ্টের সমব্যথি হবেন। তখন দেখবেন দিনে দিনে যন্ত্রণার পাথরটা সরে যাচ্ছে। যা একদিন শক্তিশালী হয়ে আপনাকে ভুগিয়েছে, অসুস্থ বানিয়ে রেখেছে। সেই সাথে একটা স্বস্তি, স্বাভাবিকতা, মেনে নেয়া তৈরি হবে। জীবনে কিছু পাবো আর কিছু পাবো না এ ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত হবে। বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।