ভালোবাসার রসায়ন

ভালোবাসার রসায়ন

আবেগে আলোড়ন ওঠে মনে, পরিবর্তন ঘটে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়, অভিব্যক্তিও বদলে যায়। বাইরে ও ভেতরের উদ্দীপকের কারণে একেক ধরনের আবেগে ঘটে একেক রকম পরিবর্তন। নারীমুখ, নারীদেহ, নারীর ব্যক্তিত্ব পুরুষের ব্রেনে কিংবা পুরুষমুখ, পুরুষদেহ, পুরুষের ব্যক্তিত্ব নারীর মস্তিষ্কের বাইরের উদ্দীপক হিসেবে জাগিয়ে তোলে আবেগ-ভালোবাসা। ভালোবাসা এক ধরনের ইতিবাচক প্রাথমিক আবেগ, ইংরেজিতে- প্রাইমারি পজিটিভ ইমোশন। ভালোবাসার গহিনে রয়েছে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা প্রেষণার গোপন তাগিদ। প্রেষণায় শক্তি সঞ্চারিত হয়, উদ্যম জেগে ওঠে, লক্ষ্যের দিকে বেপরোয়া গতিতে ছুটে যায় প্রেমিক-প্রেমিকা। অগ্রসরমান পথ থেকে তাকে সরিয়ে আনা কঠিন। বাধা পেলেই আরো শক্ত হয় ভালোবাসার ভিত; আরো বেশি দুরন্ত গতি সঞ্চারিত হয়। সামনের পথ রুদ্ধ হলে গোপন পথে চলতে থাকে নীরব বিপ্লব। সরাসরি বাধাও অনেক সময় তুচ্ছ হয়ে যায়। এ কারণেই ভালোবাসার জন্য রাজ্য ছাড়েন রাজা, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে শান্ত-সৌম্য লাজুক কিশোরী, তরুণী। এমনকি বিবাহিত নারী-পুরুষও পরকীয়ার টানে বেরিয়ে যায় ঘর ভেঙে। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সবার কথা চাপা পড়ে যায় ভালোবাসার বেগবান শক্তির পদতলে।

কোত্থেকে আসে এই শক্তি?
এই শক্তির আড়ালে রয়েছে হরমোনসহ অনেক রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গোপন চাল। অন্তর্গত রাসায়নিক পরিবর্তন আমাদের চিত্তে ঝলসে ওঠে, পাল্টে দেয় জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রেম-রোম্যান্সের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার থাকে কামের নেশা। এই নেশা প্রথমে থাকে লুকানো। সুযোগ ও সময় পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রেম ও কাম তাই বিলীন হয়ে থাকে একই মুদ্রার উভয় পিঠে। তখন সবকিছু আর আবেগের গঞ্জির মধ্যে থাকে না। রাসায়নিক উপাদানের তীব্র টানে খুলে যায় আদিম খোলস। এমন একটি উপাদান হচ্ছে ইস্ট্রোজেন হরমোন। এটিকে স্ত্রী হরমোন বলা হয়। আর একটি হচ্ছে টেস্টোস্টেরন বা পুরুষ হরমোন। নারী-পুরুষের শারীরিক গড়ন নির্ভর করে এই দুটি হরমোনের আনুপাতিক হারের ওপর। শারীরিক গড়ন, কাম-তৃষ্ণা ছাড়াও রোম্যান্টিক আবেগঅনুভূতির সঙ্গেও রয়েছে ইস্টোজেন, টেস্টোস্টেরনের গোপন খেলা। রাসায়নিক উপাদানের বিক্রিয়ার ফলে প্রেম-ভালোবাসা এবং মানবিক আবেগীয় অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। কিছু রাসায়নিক উপাদান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এই উপাদানগুলো হচ্ছে- এমফিটামিনস, ফিনাইলইথাইলামিন বা পী পদার্থ, নরইপিনেপ্রিন, এন্ডোরফিনস, অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ও ডোপামিন ইত্যাদি।

এমফিটামিনস
চকিত চাহনি, হাসির মোহনীয় উচ্ছ্বাসে কিংবা হঠাৎ স্পর্শে ব্রেনে এমফিটামিনসের নিঃসরণ ঘটে- ফিনাইলইথাইলামিন বা পী পদার্থ ও নরইপিনেপ্রিনের মাত্রাও চকিতে ছলকে ওঠে, ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা জেগে ওঠে তখন, তীব্র নাড়া খায় প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা। একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, এই নিবন্ধে বাইরে থেকে সরবরাহকৃত কৃত্রিক এমফিটামিনসের কথা বলা হচ্ছে না। ব্রেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিঃসৃত এমফিটামিনসের কথা বলা হচ্ছে।

ফিনাইলইথাইলামিন বা পী পদার্থ
ভালোবাসার তীব্র আকুলতা জেগে ওঠে পী পদার্থের কারণে। কিন্তু একই মুখ, একই চোখ, একই স্পর্শে পী পদার্থের নিঃসরণের উচ্চ মাত্রা দীর্ঘদিন একই রকম থাকে না। সময়ের পরিক্রমায় এটির নিঃসরণ কমতে থাকে এবং প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা হ্রাস পায়। প্রথমদিকের উত্তাল পুলকের নিম্নগতি শুরু হলেই বিচ্ছেদের অশনিসংকেত বাজতে থাকে। এটি মূলত পশ্চিমের ট্র্যাডিশন, বিয়ে-বিচ্ছেদ কিংবা অশান্তি তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। শরীর-মনের পুলকিত তাগিদ কমে যায় রাসায়নিক উপাদানের টলারেন্সের কারণে। এই টলারেন্স তৈরি হতে সড়বায়ুতন্ত্রের সময় লাগে ঊর্ধ্বে চার বছর। কিন্তু এরপরও তো বিয়ে টিকে থাকে, ভালোবাসা দীর্ঘায়িত হয় অনেকের জীবনে। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও গড়ে চারটি বিয়ের মধ্যে তিনটি টিকে যায়। মূলত দু’জন মানব-মানবী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার কারণে জড়িয়ে যান অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে। এই বাঁধনে শক্ত গিঁট এঁটে দেয় এন্ডরফিনস নামক ব্রেনের রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সিটোসিন নামক হরমোন।

এন্ডরফিনস
দু’জনার মাঝে শান্ত-সৌম্য নিরাপত্তার অনুভূতি জাগায় এন্ডরফিনস, উন্মাতাল ঢেউ জাগায় না। প্রধানত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার মনে। পী পদার্থের কারণটিই মুখ্য এখানে। কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। এদের প্রেম পাত্র থেকে পাত্রে সঞ্চারিত হয়। নতুন মুখ, নতুন চোখ, নতুন হাসি তুমুল উদ্দীপনায় আবার ব্রেনকে উদ্দীপ্ত করে, নতুন করেই সমান মাত্রায় পী পদার্থের নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। নতুন প্রেমের জোয়ার পূর্ণ উদ্যমে আবার চলে আসে এভাবেই। পক্ষান্তরে এন্ডরফিনসের কারণে ভালোবাসায় স্থিতি আসে, প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি সয়ে নিতে পারে। হুট করে চলে যায় না এদের ভালোবাসা। ভালোবাসা রং বদলায় না।

অক্সিটোসিন
দাম্পত্যজীবনে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও যত্নশীল হওয়ার পেছনে রয়েছে অক্সিটোসিন হরমোনের বিরাট অবদান। যত বেশি এই রাসায়নিক উপাদানটির নিঃসরণ ঘটবে, তত বেশি উভয়ে পরস্পরের কাছে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, অব্যাহত অকৃত্রিম দেহমিলনের ফলে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান দেহের ভেতর উৎপাদিত হয়। অক্সিটোসিন তখন এন্ডরফিনসের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এজন্যই অব্যাহত দেহমিলনকে দাম্পত্য বন্ধনের চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেক গবেষক। দৃশ্যমান বন্ধনের মূল পর্ব দেহমিলন হলেও মূল বন্ধনকে মহিমান্বিত করে অস্কিটোসিন। এই রাসায়নিক উপাদানটিকে তাই অফুরন্ত ভালোবাসার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। ক্রোধ, উত্তেজনা কিংবা মানসিক চাপে এড্রিনালিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে বেশি। এটি অক্সিটোসিন নিঃসরণে বাধার সৃষ্টি করে। যত বেশি ক্রোধ চাপা থাকবে তত বেশি ভালোবাসার গিঁট অক্সিটোসিনের অভাবে শিথিল হতে থাকবে। দাম্পত্য সম্পর্কে ক্রোধ অনেক সময় ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। সুইডেনের গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন, এই হরমোন কমে গেলে বন্ধুভাবাপনড়ব অনুভূতি কমে যায়। সঠিক মাত্রায় অক্সিটোসিন বন্ধুত্ব ও মাতৃত্বকে সমৃদ্ধ করে, সন্তানের প্রতি বাৎসল্য বাড়িয়ে দেয়। যেসব মা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করেছেন এবং পরবর্তীকালে শিশুকে বুকের দুধ দিয়েছেন, তাদের রক্তে অক্সিটোসিনের পরিমিত মাত্রা বজায় থাকে। ‘প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরাধরি, নিবিড় আলিঙ্গন, একসঙ্গে বসে রোম্যান্টিক সিনেমা দেখা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অক্সিটোসিন লেভেল বেড়ে যায়’। অনিয়মিত যৌনজীবন ভাটির টান তৈরি করে দাম্পত্য সম্পর্কে; ভালোবাসার বন্ধনেও- মনোবিদ ক্যাথলিন লাইটের এই বিশ্লেষণটি তুলে ধরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক সানন্দা বলছে, ‘সম্পর্কের শিথিলতায় বেরসিক স্বামীটিকে দোষ দেবেন না। দোষ দিন তার দেহে ক্ষরিত অক্সিটোসিন লেভেলকে’।

সেরোটনিন
মনে উল্লাস আসে বাড়তি সেরোটনিনের কারণে। একই সঙ্গে যৌনকামনা-বাসনা তৈরি করে সেরোটনিন। মাত্রা কমে গেলে যৌন অনুভূতিতে ঘাটতি আসে। ডোপামিন রোম্যান্স ও সেক্সি মেজাজ নির্মাণের জন্য ডোপামিনের অবদান সবচেয়ে বেশি। সেরোটোনিন ও ডোপামিন নিঃসরণের স্বাভাবিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মাত্রা মেজাজে বইয়ে দেয় সুবাতাস- ভালোবাসার টানে জাগায় প্রাণ। নিঃসরণ বেশি বেড়ে গেলে কিংবা বেশি কমে গেলে সম্পর্কে বেঁধে যায় ঘোরতর সংঘাত। সুস্থ মনের জন্য প্রয়োজন এই জৈবরাসায়নিক পদার্থ দুটির স্বাভাবিক নিঃসরণ।

ভালোবাসা কি এক ধরনের মানসিক রোগ?
দেহ ও মনের রসায়নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকজন বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক সময়ে প্রেমকে একধরনের উন্মাদনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রেমে আক্রান্ত নর-নারী চিন্তা ও আচরণে যেন স্বপড়বরাজ্যে ভেসে বেড়ায়, একটি ঘোরের মাঝে ডুবে যায়, আচ্ছন্নতা গ্রাস করে তাদের সব চাওয়া-পাওয়া। গোটা বিশ্বব্রহ্মা- গুটিয়ে এসে যেন প্রেমিকার শরীরী অবয়ব  ধারণ করে। প্রেমের এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বিজ্ঞানীরা obsessive compulsive disorder (OCD)-এর মিল দেখতে পেয়েছেন। এটি একটি লঘুতর মানসিক রোগ। ওসিডি আক্রান্তদের মনে একই চিন্তা বার বার জেগে ওঠে; একই কাজ বার বার করতে বাধ্য হয় তারা। যারা প্রেমে পড়ে তাদের মনেও একই চিন্তা, একই মুখ বার বার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।

ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেনোটেলা মারজিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মলিকুলার বায়োলজিস্ট ডিন হেমারের গবেষণার ফলাফল থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে যে, ওসিডিতে নিউরোট্রান্সমিটর সেরোটোনিন-এর মাত্রা কমে যায়, তেমনি প্রেমে আক্রান্ত নারী পুরুষের সেরোটোনিনও কম থাকে। ভালোবাসা মানসিক রোগ কিনা নিশ্চিতভাবে বলার জন্য আরো সুনির্দিষ্ট গবেষণার ফলাফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

Previous articleভালোবাসার যত্ন
Next articleভালোবাসা ও মিথ
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here