বয়স্ক মানুষের মৃত্যুভয় ও প্যানিক অবস্থা

লেখাটি একটি আনন্দ সংবাদ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭২ পুরুষদের ক্ষেত্রে ৭০ বছর। অর্থাৎ প্রবীনদের সংখ্যা বাড়ছে এবং তা সারা বিশ্ব জুড়েই। বর্তমান বিশ্ব প্রবীনদের সংখ্যা প্রায় ৯০০ মিলিয়ন অর্থাৎ সমগ্র জনগোষ্ঠির ১২ শতাংশ (২০১৫)। ২০৫০ সালে যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ বিলিয়ন। বাংলাদেশে প্রবীনদের সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ২০ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ। ২০৫০ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১ কোটি ৮০ লক্ষ। অর্থাৎ সমগ্র জনগোষ্ঠির ৯ থেকে ১০ শতাংশ। দেশে প্রবীনদের হার বৃদ্ধির বিষয়টি নিঃসন্দেহে মানব উন্নয়নের সূচকে একটি বড় অর্জন। এই বিপুল সংখ্যক প্রবীন ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশেষ করে তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ে চিন্তা ভাবনা প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বেশি।

কারণ প্রবীনদের মধ্যে বার্ধক্যজনিত শারীরিক সমস্যা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের মানসিক ও স্নায়ুবিক সমস্যার পরিমান উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। সরকারীভাবে প্রবীনদের কল্যানে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে যেমন- বয়স্ক ভাতা বিভিন্ন রেল স্টেশন বা বাস স্ট্যান্ডে টিকেট সংগ্রহের বিশেষ ব্যবস্থা এবং সাম্প্রতিক কালে করোনা মহামারিতে তাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা বিষয়ে এবং টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সামগ্রীকভাবে একজন প্রবীন ব্যক্তি যখন পরিবারে থাকেন, তখন তিনি তার দৈনন্দিন জীবনে অনেক বিষয়ে পরিবারের অন্য সদস্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েরন কিংবা অন্যদের সাহায্য সহযোগীতা ছাড়া তিনি পুরোপরি সাবলম্বী নন। প্রবীন ব্যক্তি মাত্রই অবধারিত ভাবে কিছু কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত থাকেন। যে কারনে প্রবীনদের দৈনন্দিন জীবনকে একটু হলেও আলাদা ভাবে বা বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

খুব সংক্ষেপে বলা যায়, যেহেতু একজন বয়বৃদ্ধ বা প্রবীন ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে অবহেলিত- শুধু তার চিকিৎসার বিষয়টিই নয় বরং সার্বিকভাবেই তার বেঁচে থাকাটাই যেন গুরুত্বহীন এবং অনাবশ্যক হয়ে পড়ে। সুতরাং আমরা বলা যায় এই অবহেলার কারনে তার জীবনের ঝুকি অনেক বেশি, আর তাই এই ঝুঁকি কমিয়ে তাদেরকে মোটামুটি সুস্থ্য ও সক্ষম রাখতে তাঁরা সমাজের বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখেন।

ঝুঁকিগুলির মধ্যে-

১। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক রোগঃ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিশ ম্যালাইটাস, হৃদরোগ, হাঁপানি বা অন্য কোন শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ, ধুমপান, মদ্যপান ও অন্য কোন মাদকাশক্তি ইত্যাদি।

২। মানসিক ও স্নায়ুবিক সমস্যা যেমন- অনিদ্রা, ভয়-ভীতি, উদ্বিগ্নতা, ডিমেনশিয়া, পারকিনশন ডিজিজ, সন্দেহ বাতিক রোগ, সোমাটোফরম ডিজঅর্ডার, বিষন্নতা এবং কখনো কখনো আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পরিনতিও দেখা যায়।

৩। সামাজিক আরো কিছু সমস্যা তাঁদের মধ্যে অনিবার্যভাবে দেখা যায় যেমন- দারিদ্র, একাকিত্ব, পরনির্ভরশীলতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য, পরিবারিক ও সামাজিক নিগ্রহ, প্রবীনদের বোঝা মনে করা, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য। একজন বয়স্ক ব্যক্তি শারীরিক দক্ষতা অনিবার্যভাবে কমে যায়, প্রিয়জনের সংখ্যা কমে যায়, প্রিয়জনরা দুরে চলে যায়, উপার্জন কমে যায়, সব মিলিয়ে একধরনের নিরাপত্তাহীনতা তাদের মধ্যে কাজ করে।

প্রবীন ব্যক্তিরা যখন কোন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন তখন তার রোগের উপশর্গগুলিকে প্রবীন বয়সের স্বাভাবিক পরিনতি বলে মনে করা হয়। কাজেই তার যে কোন মানসিক কষ্ট হচ্ছে এটি আদৌ চিন্তা করাই হয় না। তাছাড়া এখন অনেক উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রবীনদের মানসিক সমস্যাগুলিকে ঠিকমত নিরুপন করা হয় না বা ভুল করা হয়। সাধারনত একজন প্রবীন ব্যক্তিকে যখন মনোচিকিৎসকের কাছে আনা হয়, তখন ধরে নেয়া যেতে পারে তার কোন নির্দিষ্ট মানসিক উপসর্গ দেখা দিয়েছে। শারীরিক রোগের উপসর্গগুলি ছাড়াও যদি কোন প্রবীন ব্যক্তির মধ্যে বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, অনিদ্র, সাইকোসিস বা স্মৃতিভ্রম বা ডিমেনশিয়ার উপশর্গ পাওয়া যায় এবং এ সব উপশর্গ যদি দীর্ঘ দিন চলতে থাকে এবং তার তীব্রতার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্বি পায় তখন অবশ্যই আমাদের ব্যক্তির মধ্যে মানুষিক সমস্যার উপস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে।

সমাজে প্রবীনরা নানা ভাবে অবহেলা বা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এসবের মধ্যে শারীরিক, মানসিক এবং উভয় রকমেরই সমস্যা হতে পারে। মানসিক নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে- রোগীর সাথে দুর্ব্যবহার করা, অসম্মান করা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা এবং ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন। শারীরিকভাবে রোগীর সাথে দুর্ব্যবহার করা, গালমন্দ করা এমনকি শারীরিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের ঘটনাও একেবারে কম নয়। বিষয়টি প্রতিষ্ঠানিক এবং পারিবারিক উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। গবেষনায় দেখা গেছে প্রায় ৪-৬ শতাংশ প্রবীন নিজের বাড়িতেই অবহেলা এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। সচরাচর যেটি দেখা যায় তা হচ্ছে, গালমন্দ করা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা। সাধারনত প্রবীনদের এধরনের নির্যাতনের সংবাদ সঠিকভাবে প্রকাশিত হয়না, আর হলেও খুব কম হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৬ সালে প্রায় চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার প্রবীন বিভিন্নভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যদিও পরিসংখ্যানটি পুরাতন কিন্তু বিষয়টির তীব্রতা সম্পর্কে কিছুটা ধারনা করা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে সাধারনত পরিসংখ্যান পাওয়ার বিষয়টি খুব কঠিন। এসব প্রতিষ্ঠানে যে সব কর্মী কাজ করেন, তারা সব সময় খুব সাবধানে এই বিষয়টি এড়িয়ে যান, তার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের ৩৬ শতাংশ কর্মী শিকার করেছেন যে তারা প্রবীনদের উপর শারীরিক নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন এবং ১০ শতাংশ কর্মী শিকার করেছেন যে তারা নিজেরাও এই রকম একটি অমানবিক কাজে অংশগ্রহন করেছেন।

গবেষনায় দেখা গেছে প্রবীনদের নির্যাতন এবং অবহেলার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে তাদের শারীরিক দুর্বলতা, অন্যের উপর নির্ভরশীলতা এবং একাকিত্ব। অনেক সময় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের যে সব কর্মী প্রবীনদের দেখাশুনা করেন, তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত অবস্থায় প্রবীনদের উপর বেশি নির্যাতন করেন। সুতরাং একজন প্রবীন যখন তার পরিবারে বা কোন প্রতিষ্ঠানে তার জীবনের শেষ সময়গুলি কাটাতে থাকেন তখন এরকম নেতিবাচক পরিস্থিতিতে তাঁদের মধ্যে ভয়ের উদ্ভব হয়। বিশেষ করে শারীরিক নির্যাতন, অপমানিত হওয়া এবং সর্বোপরি মৃত্যুর ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করে। প্রবীনদের প্রতি পারিবারিক সহিংসতার নানা ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। এই সব দুখঃজনক ঘটনা যে কত নির্মম ও বেদনাদায়ক হতে পারে সে বিষয়ে অনেকেরই বাস্তব ধারনা নাই। প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটি ছোট গল্প “ঝগড়া” থেকে খানিকটা উল্লেখ করলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যাবে। গল্পের প্রধান চরিত্র কেশব গাঙ্গুলী সন্ধ্যার আগে হাট থেকে ফিরলেন, তার বয়স ৭২ বছর। চলতে তার আজকাল পা কাপে, আগের মত শক্তি নেই আর শরীরে। দশ শের ওজনের ভারী মোট মাথায় করে ভীষন কর্দময় পিচ্ছিল পথে কোন রকমে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে কেশব গাঙ্গুলী হাটের বোঝা বাড়ি নিয়ে এলেন। কেশব গাঙ্গুলীর সংসারে তার স্ত্রী মুক্তকেশী ছাড়া আরো দুই কন্যা আছেন। প্রতিদিনই তারা কেশব গাঙ্গুলীর সাথে নানা রকম র্দুব্যবহার করে থাকেন, কেশব গাঙ্গুলী যেন তাদের বাড়ীর কাজের মানুষটি। মুক্তকেশী বলল, দেখি কিরকম বাজার করলে? পটলগুলো এত ছোট কেন? কত করে সের? দশ আনা। ও বাড়ী পল্টু এনেছে নয় আনা সের। তুমি বেশি দর দিয়ে নিয়ে এলে, তাও ছোট পটল। ও কখনো দশ আনা সের না। বা আমি মিথ্যা বলছি? তুমি বড্ড সত্যবাদি যুধিষ্টির তা আমার ভাল জানা আছে। আচ্ছা রও ও পোটল আমি ওজন করে দেখবো। কেন আমার কথা বিশ্বাস হলো না?

-না। তোমার কথা আমার বিশ্বাসতো হয়ই না। সত্য কথা বলব, তার আবার ঢাক ঢাক গুড় গুড় কি? এই হলো সুত্রপাত। তার পর কেশব গাঙ্গুলী হাত পা ধুয়ে রোজাকার মত বললেন, ও ময়না (মেয়ে) চাল ভাজা নিয়ে আয়—, ময়না কথা বলে না, চালভাজার বাটিও আনে না। তাতে বুঝি কেশব বলেছিলেন- কৈ, কানে কি তুলো দিয়ে বসে আছো নাকি, ও ময়না? ছোট মেয়ে নিরস সুরে বলল, চাল ভাজিনি। কেন? রোজ রোজ চাল ভাজা খাওয়ার চাল জুটছে কোথা থেকে? তাছাড়া আমার শরীর ও ভাল ছিল না। কেন, তো দিদি? দিদি সেলাই করছিল।

এটা খুবই সাভাবিক যে ৭২ ও ৭৩ বছরের বৃদ্ধ কেশব গাঙ্গুলী দশ সের ভারী মোট বয়ে এনে মেয়েদের এই উদাসিনতায় বিরক্ত হবেন বা প্রতিবাদে দু কথা শোনাবেন কিন্তু তার ফল দাড়ালো খুবই খারাপ। ছোট মেয়ে ময়না তাকে একটা ভাঙ্গা ছাতার বাট তুলে মারতে এলো। মেঝো মেয়ে লিলা বলল- তুমি মরনা কেন? মরলে তো সংসারের আপদ চোটে- স্ত্রী মুক্তকেশী বলল, এমন আপদ থাকলেও যা না থাকলেও তা-

কেশব গাঙ্গুলী রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বললেন, আমি তোদের ভাত আর খাব না- চললাম। মুক্তকেশী ও ছোট মেয়ে এক সাথে বলে উঠল যাও না যাও। ময়না বলল আর বাড়ী ঢোকনা, মনে থাকে জানি। কেশব গাঙ্গুলী বাইরের ভাঙ্গা চন্ডিপমন্ডে শুয়ে রইলেন, কেউ এসে ডাকলো না, মাও না মেয়েও না। সত্যি কেউ ডাকতে আসবে না এটা কেশব গাঙ্গুলী ভাবতেও পারেন নি। তাই ঘটে গেল অবশেষে। না খেয়ে সমস্ত রাত কাটল কেশব গাঙ্গুলী- নিজের পৈত্রিক ভিটেতে, স্ত্রী ও দুই কন্যা বর্তমানে। এরপর কেশব গাঙ্গুলী আর বাড়ি ফেরেন নি। অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মী হিসেবে রেলের পাস দেখিয়ে বিনে ভাড়ায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে অনাহারে অনিদ্রায় একদিন কোন স্টেশনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। কৌতুহলী লোকজন এসে তার পড়নে রেলের কোর্ট দেখে তাকে সনাক্ত করেন কিন্তু ততক্ষনে কেশব গাঙ্গুলী তার সকল রকমের মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রনা ও লাঞ্চনার ঊর্ধ্বে।

সুপ্রিয় পাঠক, আপনারা হয়ত বলবেন, এটি বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যয়ের অসাধারন লেখনি শক্তি ও কল্পনার ফসল, কিন্তু আমি বলি কল্পনার তো একটি অবলম্বন চাই!

বার্ধক্য কেন আসে, তা নিয়ে নানা মতানৈক্য আছে এবং নানা গবেষনা চলছে। বার্ধ্যক্য ঠেকিয়ে রাখতে মানুষের চেষ্টার কমতি নাই, তবে সার্বিকভাবে বংশগতি পরিবেশ, জীবন আচার, খাদ্যাভ্যাস, জলবায়ু ইত্যাদি বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ন। সাম্প্রতিক কালে ফ্রি রেডিকেল তত্ত্বটি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে, বলা হয় অধিক ক্ষয় হওয়ার কারন হচ্ছে অধিক ফ্রি রেডিকেল তৈরী হওয়া এবং সেই সাথে বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরের পুর্নগঠন এর ক্ষমতা কমে গিয়ে ভারসম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। চলমান ক্ষয়গুলোকে পুর্নগঠন বা প্রতিস্থাপন করতে হলে যে কোষ বিভাজন প্রয়োজন তার জন্য জেনেটিক বা ডিএনএ এর নিয়ন্ত্রনের প্রয়োজন আছে। টেলোমেরিক ডিএনএ ক্রোমোজোমের বিন্যাস ও স্থায়িত্বকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। ডিএনএ যদি র‍্যান্ডাম ড্যামেজকে প্রতিস্থাপন করতে পারে তাহলে কি মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী হবে? ডিএনএ এর মাধ্যমে মানুষের আয়ু বাড়ানো যাবে? সম্ভাবনা কম। জিনগুলি একাধিক মিউটেশনের মাধ্যমে তার কোষের আজ¯্র কার্যাবলী নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা নিয়মিত হারাচ্ছে। তাই আমরা উপনিত হচ্ছি ক্রমাগত বার্ধক্য এবং অবধারিত মৃত্যুর দিকে।

কিভাবে এ বিপুল সংখ্যক প্রবীন ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভাল রাখা যায়- নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল পরিকল্পনা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে সকলের আন্তরিক এবং সক্রিয় সহযোগীতার মাধ্যমে হয়তো এই সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান সম্ভব হতে পারে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য ওলড হোম সহ হাসপাতালেও জেরিয়েট্ররিক সার্ভিস চালু আছে। আমাদের দেশে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে বা চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যান্য কোন ক্ষেত্রেও প্রবীনদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি নি। যদিও বাংলাদেশে কিছু কিছু বিশেষায়িত মানসিক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে প্রবীনদের মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার নিয়মিত চিকিৎসা প্রদান করা হয় যেমন

(ক) জাতীয় মানষিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতাল,

(খ) মনোরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

(গ) সরকারী ও বেসরকারী মেডিকেল কলেজ সমূহের মনোরোগ বিভাগ।

(ঘ) আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজ মনোরোগ বিভাগ

(ঙ) পাবনা মানসিক হাসপাতাল

(চ) বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ক্লিনিক সমূহ।

রোগ নির্নয় প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বার্ধক্যজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ মনে করে থাকেন, রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষা, নিরিক্ষা তার বাড়িতেই হওয়া উচিত, কারন রোগী যে পরিবেশে দৈনন্দিন কাজকর্ম করেন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে একত্রে বসবাস করেন তা থেকে অনেক তথ্য জানা যেতে পারে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে রোগীর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যেতে পারে। এসময়ে আরও কতগুলি জরুরী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যেমন-

১। নিজ বাড়িতেই রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব কিনা

২। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে কি ধরনের সাহায্য সহযোগীতার প্রয়োজন।

৩। রোগী বা তার পরিবার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন কিনা?

রোগ নির্ণয়ের সময় রোগের বিস্তারিত ইতিহাস শারীরিক পরীক্ষ এবং তার সম্ভাব্য সামাজিক সমস্যার বিস্তারিত জানা দরকার। সম্ভব হলে রোগীর নিকট আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের সাথে আলাপ করা দরকার। বিশেষ করে যারা রোগীর সেবা যত্নের জন্য সময় দিতে পারবেন।

রোগীকে কোন পরিস্থিতিতে হাসপাতালে বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট পাঠান হয়েছে সে বিষয়টিও জানা দরকার কারন দেখা যায় রোগীর আচরন কোন কোন সময় এতই অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে যা প্রতিবেশী বা আত্মীয় স্বজনের জন্য অসহনীয় হয়ে যায়। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের পর প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীর নিজস্ব পরিবেশকে বেছে নেয়া উচিৎ। কখনও কখনও বিশেষ ধরনের পরীক্ষা বা সামাজিক কারণে রোগীর চিকিৎসা হাসপাতালে করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

সিজোফ্রেনিয়া, বিষন্নতা, মাথাধরা, অনিদ্রা ইত্যাদি বার্ধক্যজনিত মানসিক সমস্যার চিকিৎসা বা নিরাময় এখন বহুলাংশে সম্ভব হয়ে উঠেছে। কারণ অনেক উন্নতমানের ঔষধ ও মনোচিকিৎসা এসব রোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে পারে।

বার্ধক্য সবচাইতে দুঃখজনক ও কষ্টদায়ক তা হচ্ছে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রষ্টতা। একজন প্রবীন যখন ক্রমশ স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে থাকেন, এটা তার কাছে সহজে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাড়ায় এবং তা থেকে তাঁর নানা রকমের আচরনগত সমস্যা দেখা দেয় যা অনেক সময় অন্যেরও বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডিমেনশিয়া রোগের সঠিক কোন চিকিৎসা আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি যে কারনে স্মৃতিভষ্টতার পরিনতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেদনাদায়ক। আরো বেদনা দায়ক বিষয়টি হচ্ছে আমাদের যৌথ পরিবার প্রথা ক্রমশই শেষ হয়ে আসছে। একান্নবর্তী পরিবারে অনেক সদস্যেও মাঝে একজন প্রবীনের দেখা শুনা ও সেবা যত্নের বিষয়টি ছিল অত্যন্ত অনায়াস যা এখন প্রায় দুর্লভ। ফলে সংসারে থেকে একজন প্রবীনের দেখাশুনা করা ক্রমশই অসম্ভব হয়ে উঠছে।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব রোগেরই সংক্রামক ও অসংক্রামক এমনকি মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধের গুরুত্বই বেশি দেওয়া হয় এবং সেটি সবচাইতে ফলপ্রশু ও লাভজনক পদ্ধতি। সুতরাং বার্ধক্য বা বার্ধক্যজনিত সমস্যগুলোকে এড়িয়ে চলতেও প্রতিরোধের বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেমন- ভুল ভ্রান্তি এড়িয়ে থাকতে চাইলে মস্তিষ্ক সচল রাখুন, নিয়মিত পড়াশুনা করুন, বেশি চিন্তাভাবনা করা দরকার এমন কাজ এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহন করুন, শরীর চর্চা করুন, কোন কোন কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যপ্ত রাখুন, স্মৃতিভ্রংশ ভাবটা কমে যাবে। যাদের বয়স বেড়েছে প্রবীন হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি দরকার। আসলে বিষয়টি চর্চার। One should learn to grow old. অর্থাৎ প্রবীন হওয়ার জন্য এবং বার্ধক্যে সুস্থ্য থাকার জন্য একজনকে শিখতে হয়। বয়স বাড়লেই প্রকৃত প্রবীন হওয়া যায় না বরং জরাজীর্ন হয়। অস্ত্রকে নিয়মিত ধার দিলে অস্ত্রেও ধার বজায় থাকে, আমাদের মস্তিস্ক এক ধরনের অস্ত্র। মগজটি নিয়মিত খাটান, দেখবে বুদ্ধি এবং স্মৃতি বজায় আছে। অদ্ভুত এক সংস্কার আমাদের মধ্যে কাজ করে। আমরা ধরেই নিই নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত হওয়ার পর আমাদের শারীরিক ক্ষমতা কমবে সে সংগে মানসিক ক্ষমতা। অর্থাৎ বার্ধক্যকে আমরা নিজেরই আহবান জানাই। বার্ধক্য মানেই অবসর। মানে কাজকর্ম থেকে বিদায়। জীবনের বাকী দিনগুলো কোনক্রমে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেওয়া। আর এভাবেই শেষ হয়ে যাবে প্রদীপের শেষ বিন্দু তেল। এমনি একটি সিদ্ধান্ত নিজেদের অজ্ঞাতসারেই গড়ে তোলেন তাঁরা। এর ফলে শারীরিক ও মানসিক অবক্ষয় চলতে থাকে দ্রুতলয়ে। শরীর পঙ্গু হয়, মনের বাঁধুনী হয় আলগা। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, সে সঙ্গে কমে যায় আত্মবিশ্বাস।

একথা ঠিক যে, তথাকথিত কর্মময় জীবন থেকে অবসর একদিন নিতেই হয়, তার মানে এই নয় যে, সম্পূর্ন বিশ্রাম। জীবনের এই পর্যায়ে কত রকম কাজইনা করার থাকে-

নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে নিয়মিত সেই কাজে নিজেদের জাড়িয়ে রাখলে শরীর এবং মন দু-ই থাকে সজীব। আসলে বার্ধক্য ব্যাপারটা যতটা না শারীরিক তারচেয়েও বেশী মনের। মনকে প্রস্তুত করুন। পরিশ্রম করুন, দায়িত্ব নিয়ে কোননা কোন কাজ করুন, সে কাজ সংসারেরও হতে পাওে অথবা সামাজিক সেবামূলক কোন কাজ। দেখবেন বার্ধক্য সরে রয়েছে। মনের দিক থেকে আপনি যথেষ্ট পরাঙ্গম।

বয়বৃদ্ধ কোন রোগ নয়। বরং স্বাভাবিক জীবন চক্রের একটি পর্যায়। প্রখ্যাত সাইকোলোজিষ্ট এরিকশন বলেছিলেন, পৌড়ত্ব কোন হতাশা, বিষন্নতা বা শুন্যতা নয় বরং এক ধরনের পরিপূর্নতা অখন্ডতা বা সম্পূর্নতা। আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক তরুন ব্যক্তি নানা ভাবে অবহেলার শিকার হয়ে দুর্দশাগ্রস্থ জীবন যাপন করছেন। আমরা আমাদের প্রবীনদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের যেমন সক্ষম রাখতে পারি তেমনি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করতে পারে। তাই বার্ধক্যে ভাল থাকতে বা প্রবীনদের ভাল রাখতে প্রয়োজন প্রবীনদের আত্মমর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার বিধান করা।

লিখেছেন: অধ্যাপক ডা. মোঃ ওয়াজিউল আলম চৌধুরী

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleঅবসর কখন নেওয়া উচিত?
Next articleবড়দের মতো শিশুদেরও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here