বিষণ্ণ মনের গতিপ্রকৃতি

মন

মুন্নীর মন ভালো নেই। তার বাইরে বেরোনো দরকার, কিছু উপহার কিনতে হবে। রাবুর ম্যারেজ-ডে আজ। অথচ বাসা থেকে বের হতেই ইচ্ছে করেছে না তার। ক্লান্তিতে জড়িয়ে আছে দেহমন। হাজব্যান্ডসহ এসেছিল রাবু, অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে গেছে বাড়িতে এসে। যেতেই হবে। কারণ রাবু ওর বান্ধবী, ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর চেয়েও বেশি কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে। একই হলে এক কক্ষে থেকেছে। দুরন্ত সময় পার করেছে ওরা। এক মুহূর্তের জন্য রাবুকে না দেখে থাকতে পারত না মুন্নী। অথচ আজ! সময় যেন বড়ো শত্রু; সব আনন্দ-ভালোবাসা চুষে নিয়ে গেছে। প্রকৃতির সবুেজর উন্মাতাল হাওয়ায় কত ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। সেই গাছগাছালিকে মনে হয় মৃত শাল। শীতল বাতাসের আদুরে পরশকে মনে হয় তিক্ত স্পর্শ।

‘মুন্নী! এই মুন্নী!’ ভেতরের রুম থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসছে। জবাব দিচ্ছে না ও। চুপ মেরে আছে, যেন মুন্নী বলে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব এ ঘরে নেই। সাড়া না পেয়ে মা উঠে এসে বললেন, ‘চুপ করে আছিস কেন? ডাকছি আমি, শুনছিস না?’ মাথা তুলে তাকাল না মুন্নী। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন মেঝেয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক মণিমাণিক্য-রতনরাজি; নিবিড় করে তারই সৌন্দর্য ও পান করছে প্রাণভরে। মা স্থির চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে ফিরে গেলেন ক্ষোভের সঙ্গে। মুন্নী পাত্তাই দিল না মাকে। নিজ ঘরে মোড়ায় বসেছিল ও এতক্ষণ, মোড়া থেকে উঠে দাঁড়াল। বাঁ দিকে ঘুরতেই আয়নায় চোখ পড়ল। নিজের মুখের ওপর চোখ পড়তেই হু হু করে কেঁদে উঠল ও। পরিবারের বড়ো মেয়ে মুন্নী। তিনটি ছোট বোন রয়েছে তার। কোনো ভাই নেই। সংসারে স্বচ্ছলতা আছে। বাবা উচ্চপদে চাকরি করেন। ইস্কাটনে সরকারি বাসায় থাকে ওরা।

মুন্নীর চেহারাটি খুবই মায়াবী। তবে গায়ের রং কালো। বেশ কালো। কালো হলেও বুদ্ধিদীপ্ত মুন্নীকে একনজর দেখেই ভালো লেগে যায় সবার। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে মুন্নীর ছিল অনেক বন্ধু। ছেলেমেয়ে বন্ধুর সংখ্যার কমতি ছিল না। তবে কেউ ওর সঙ্গে প্রেম করতে চাইত না, প্রেমের ভাব করত। দু-এক দিন পরই শরীরের দিকে হাত বাড়াত ছেলেরা। সব ছেলের দাবিকে ও কৌশলে এড়িয়েছে। একজনকে এড়াতে পারেনি। সেই একজনের কথাও ভাবতে চায় না। তবে ভাবনায় এসে যায় সে। ভার্সিটি জীবনে কিছুই বুঝতে পারেনি ও, এখন বুঝছে সব। ধীরে ধীরে সব বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে তার বিয়েই বাকি। উহ!

বিয়ের কথা মনে হতেই মাথাটা টনটন করে ওঠে। বাবা-মা অস্থির হয়ে গেছেন, আত্মীয়স্বজনের পিন ফোটানো কথা নিজের মধ্যে বিরক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কত ছেলে দেখে যাচ্ছে। সেজেগুজে ফরমালি, ইনফরমালি কতবার মহড়া দিল! কেউ তো বিয়ে করতে চায় না। তবে আকারে-ইঙ্গিতে বলে যাচ্ছে-মেয়ে বেশ মিষ্টি। মিষ্টি ধুয়ে কি পানি খাবে? বিয়ে করতেই হবে, এমন ধারণা তার ভেতর নেই। বিয়ে ছাড়াই পুরাে জীবন কাটিয়ে দেবে-এ রকম এক প্রত্যয়ী মন ছিল ওর। সেই মনের শক্ত দেয়ালে ধস নেমে গেছে। কিছুই ভালো লাগছে না। কতবার চাকরির ইন্টারভিউ দিল। না, হলো না। হবে বলে মনেও হচ্ছে না। বিসিএস দেওয়া দরকার, পড়তে ইচ্ছে করছে না। এ সময় বাবা শাহবাজ চৌধুরী এসে রুমে ঢুকলেন। আলতো হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়। ‘মা, আজ শেষবার। আর তোকে সাজতে বলব না। আজ আমার বাল্যবন্ধু আসবে, ওর ছেলের জন্য তোকে পছন্দ করেছে। আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবে।’ মুন্নী ঘুরে তাকিয়ে বাবার চোখে চোখ রাখল। বাবার কষ্ট ও টের পায়। নিজের কষ্টের পাহাড় টপকে বাবার যন্ত্রণাকে ছুঁয়ে দিল ওর চোখ। ‘কখন আসবেন উনি?’ ‘আজ বিকেলে। এখনো বেশ সময় হাতে আছে। বাইরে যেয়ো না। রেডি থেকো। কেমন!’ ‘আচ্ছা।’ ছোট্ট করে জবাব দেয় মুন্নী।

সন্ধ্যার লাল আভা পশ্চিমাকাশে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মুন্নী। আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর করে শ্বাস নিল ও। এত বিশাল আকাশ। অথচ মনে হয় কত ছোট। চারপাশ যেন ছোট হয়ে আসছে। হঠাৎ নিচে ট্যাক্সির আওয়াজ পেল ও। হ্যাঁ, বাবার বন্ধু আসছে। সঙ্গে আছে একজন। নিচে নেমে এল মুন্নী। আগেই সেজেছিল। নিজ রুমে ঢুকে বসে রইল। বাসায় হইহই রব। রাত দশটা বেজে গেছে। কারো খাওয়ার কথা যেন মনে নেই। অথচ নটার মধ্যে ওরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে। ছেলের বাবা মেয়ে পছন্দ করেছে। আংটি পরিয়ে দিয়ে গেছে। মহা আনন্দসংবাদ। ছেলে কী করে, কী তার যোগ্যতা-সেটি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। যেন ছেলে হলেই হলো। ছেলের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটিও কেউ ভাবছে না। রাত প্রায় এগারোটা। হঠাৎ বাবার কণ্ঠ ভেসে এল, মুন্নী, এই মুন্নী। শুয়ে ছিল মুন্নী, ঘুম আসেনি। বাবার ডাক শুনে উঠে বসল। তিনি দ্রুতই এসে  ‍ঢুকলেন রুমে। বেশ আনন্দিত চোখ, নিশ্চয় কোনো সুসংবাদ। ‘তোর টেলিফোন, লিটন ফোন করেছে। আমার বন্ধুর ছেলে লিটন, যার সঙ্গে তোর বিয়ে পাকা হলো, সেই লিটন। আয়! টেলিফোন ধর।’ মুন্নী ওঠে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। টেলিফোন বাবার রুমে। বাবা রুমে নেই, সবাই বেরিয়ে গেছে, এখন ও একা। রিসিভার হাতে তুলে নেয় মুন্নী বেশ কতক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মৃদুস্বরেই বলে, ‘হ্যালো, মুন্নী বলছি।’ ‘থ্যাংকস মুন্নী, টেলিফোন রিসিভ করলেন এজন্য ধন্যবাদ আপনাকে।’ মুন্নী চুপ করে আছে। ‘শুনছেন!’ লিটনের উত্তেজিত জিজ্ঞাসা। ‘হ্যাঁ, শুনছি। বলুন।’ ‘আমার খুব বিপদ, ব্যাপারটি আপনাকে জানানো উচিত। প্লিজ আপনি মন খারাপ করবেন না, শক্ত হয়ে শুনুন আমার কথা।’ ‘বলুন, শুনছি।’ মুন্নী ধীরস্থির। স্বরে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ‘আমি, আমার এক সিনিয়র মহিলা কলিগের সঙ্গে প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি। বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা, মেয়েটি কালো। তবুও আমার খুব পছন্দের। কিন্তু যেহেতু সে বয়সে বড়, যেহেতু তারা গরিব সেজন্য বাবা কিছুতেই বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না। উলটো আমাকে বুঝিয়েছে আপনাকে বিয়ে করার জন্য। প্লিজ, আপনি এ বন্ধন মেনে নেবেন না। যে আংটিটি বাবা পরিয়েছে সেটিতে আমার মত নেই।’ মুন্নী রিসিভার রেখে দিল। কোনো অভিব্যক্তি নেই তার। ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল। বিছানায় এলিয়ে দিলো নিজেকে। অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। ঘুম আসছে না। নিজের ভেতর অপরাধবোধ জাগছে। অতীতের ঘটনা মনে পড়ছে। পূর্বপরিচিত খালি ওই ছেলেটির আচরণ মনে পড়ছে। শরীরে যেন কিলবিল করে হেঁটে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কালো হাত। এ পাপের কারণেই কি সব ব্যর্থতা আসছে জীবনে? অতীতকে তার নোংরা মনে হতে থাকে। অতীতের কদর্য গন্ধ বর্তমানেও এসে নাকে ঢুকছে।

সবকিছুতেই ও ব্যর্থ, আলোকিত ঘরবাড়ি অর্থহীন মনে হতে লাগল। ভবিষ্যতেরও কোনো মূল্য নেই। অন্ধকার ভবিষ্যৎ। দিশেহীন ভবিষ্যতে গিয়ে কী লাভ! মরে যাওয়াই তো উত্তম। বেঁচে থাকার কীই-বা মূল্য আছে? ভাবতে থাকে ও, ভাবতে ভাবতে একসময়, অনেক পরে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোররাতের অনেক আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। ছটফট করতে থাকে ও। চোখ মেলে অন্ধকারে বসে থাকে কিছুক্ষণ। আবার শুয়ে পড়ে, না ঘুম আসছে না। সবাই উঠে পড়েছে, চনমনে আনন্দিত মন নিয়ে কলকল করছে। সকাল আটটায় ডাইনিং টেবিলে বসেছে সবাই। নাস্তা করতে হবে। না, মুন্নী এল না। খেতে ইচ্ছে করছে না। একদম খিদে নেই। ক্লান্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে হাত, পা। উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। ভেতর থেকে কোনো তাগিদও পাচ্ছে না। অশান্তিতে ছেয়ে গেছে মন। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে একসময় মরে যাওয়ার তীব্রতা জাগে। কোথা থেকে আসছে এ ইচ্ছের স্রোত, জানে না ও। অপ্রতিরোধ্য এই বেপরোয়া শক্তির কাছে এখন নতজানি। পরিকল্পনা ঢোকে মাথায়, বাসা থেকে বের হবে। ফার্মেসিতে যাবে। ঘুমের বড়ি জোগাড় করবে-সব একসঙ্গে খেয়ে চলে যাবে মৃত্যুর কালো জগতে। এ জগৎকেও তার কালোই মনে হয়। মনে হয় আলো নেই, আলো নেই… কোথাও আলো নেই…

মনোবিশ্লেষণে মুন্নী মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়েছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে মুন্নী। মৃত্যু বা আত্মহননের পরিকল্পনা করছে ও। এটি একটি মানসিক রোগ। চিকিৎসায় সারিয়ে তোলা সম্ভব। এ ধরনের পরিস্থিতি গড়াতে থাকলে মুন্নী আত্মহত্যা করার পথে এগিয়ে যাবে। আমাদের রয়েছে সচেতনতার অভাব। তাই সঠিক সময়ে পরিবারের কেউ এই অস্বাভাবিক আচরণ বা চিন্তার খবর পাই না। সমাজে যে আত্মহননের খবর আমরা পত্রিকায় পাই, ৬০ শতাংশ ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে সুইসাইডের পথ বেছে নেয়। সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানসিক চিকিৎসাসেবা নেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, সাইকিয়াট্রিস্টরা কেবল উন্মাদগ্রস্ত রোগীরই চিকিৎসা করেন না। আরো অনেক দেহগত সমস্যারও চিকিৎসা করেন, যার উৎপত্তিস্থল মন। তাই মনোচিকিৎসকের কাছে হাজির হতে লজ্জার কোনো কারণ নেই। থাকা উচিত নয়। শুধু প্রয়োজন সামাজিক এ ভ্রান্ত দেয়ালটির ভিত উপড়ে দেওয়া। মন ও মনের সমস্যার ব্যাপারে সজাগ হওয়ার বিকল্প কিছু নেই।

*লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

 

Previous articleক্লসট্রফোবিয়া বা আবদ্ধতাজনিত ভয়!
Next articleনেতিবাচক চিন্তা স্মৃতিশক্তি কমায়
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here