১.
মুখটা মাখনের মতো মসৃন, গায়ের রং সাদা আর ঘিয়ের মাঝামাঝি, চোখ দুটি নীল, খয়েরী পাঞ্জাবী আর সোনালী ওড়নাতে স্বপ্নের মতো লাগলো।
প্রথম ধাক্কাটা খেলাম তার সাথে কথা বলে। সে কথা বলছে পুরুষ কন্ঠে। শুধু কন্ঠ কেন (!), শারীরিক সব দিক থেকে একজন পুরুষইতো দেখছি! কিন্ত তার মন সেটা মানতে নারাজ । সে বিশ্বাস করে, সে একজন নারী। তার ভিতরের সত্ত্বা একজন নারীরই সত্ত্বা। কিন্তু ভুল করে সে পুরুষের শরীরে এসে পড়েছে।
নারীর মত চলন, নারীর মত পোষাক । বিষয় হলো, সে নারী হয়েই বাচঁতে চায়। প্রয়োজনে অপারেশন করাতে রাজী আছে। ইতোমধ্যে অপারেশন করাবার জন্য একজন শৈল্য বিশেষজ্ঞের সাথে দেখাও করেছিল, কিন্তু তিনি তাকে মনোরোগ বিভাগে রেফার করে দিযেছেন, রোগ নির্নয়ের জন্য।
আমরা তার সাথে কথা বলে, পূর্বাপর সবকিছু বিশ্লেষন করে যা বুঝলাম তা হল ছেলেটি ‘জেন্ডার ডিসফোরিয়াতে’ ভুগছে। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেশী নয়। বছরে একজন কি দুইজন এমন সমস্যা নিয়ে আমাদের ক্লিনিকে (সাইকিয়াট্রিক সেক্স ক্লিনিক) আসেন।
সবচেয়ে বেশী আসেন সেক্সুয়াল ডিসফাংশন নিয়ে। প্রায় দশ ধরনের সেক্সুয়াল ডিসফাংশন আছে।
২.
২০১০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যাবিভাগ সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয় সেক্সুয়াল ডিসফাংশন ও অন্যান্য যৌন সমস্যায় ভোগা রোগীদের পৃথক সেটআপে দেখার জন্য। আর সেটিরই নাম দেয়া হয়, ‘সাইকিয়াট্রিক সেক্স ক্লিনিক’। সেবা শিক্ষা প্রশিক্ষন ওগবেষনার সুবিধার জন্য এই উদ্যোগটা প্রয়োজন ছিল।
এই বিশেষায়িত কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য রোগী সেবা পেয়ে আসছে। যেহেতু আলাদা সেটআপে দেখা হচ্ছে, তাই রোগীদেরও বুঝতে সুবিধা হচ্ছে এধরনের সমস্যা নিয়ে কোথায় কোনদিন, কখন দেখা করতে হবে।
বিশ্ব বিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ যেমন চর্ম ও যৌন, ইউরোলজী, এন্ডোক্রাইনোলজী, স্ত্রীরোগ বিভাগ প্রয়োজনে যেমন রোগী রেফার করতে পারছে, আবার তাদের চিকিৎসকদের পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষনও নিতে পারছে এই ক্লিনিক থেকে।
যৌন সমস্যা নিয়ে মনোরোগ বিভাগ ,সাইকোথোপী উইং ও সাইকিয়াট্রিক সেক্স ক্লিনিকের উদ্যোগে আয়েজিত সায়েন্টিফিক সেমিনার গুলোতে বিশ্ববিদ্যিালয়ের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎকদের অংশগ্রহনের ফলে, এবিষয়ে চিকিৎকদের ভিতরও সচেতনতা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশী।
৩.
মিডিয়ার সহায়তায়, আমরা ভায়াগ্রা সম্বন্ধে এখন অনেকেই জানি।
ভায়াগ্রা আবিস্কারের পর থেকেই মূলধারার চিকিৎসকরা যৌনরোগের চিকিৎসার ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর আগে, ‘ইরেকটাইল ডিসফাংশন’ (বা লিঙ্গ উত্থান জনিত সমস্যা) এর নির্ভরযোগ্য কার্যকরি ঔষুধ চিকিৎকদের কাছে ছিল না । হারবাল ঔষুধ আর সেক্সথেরাপীই ছিল ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের চিকিৎসা। হারবাল ঔষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা মূলধারার চিকিৎসকরা অনুভব করেন, তা হল বেশীরভাগ ঔষুধই যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া বাজার জাত করা হয়।
ঔষুধ সংক্রান্ত গবেষনালব্ধ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ না করা হলে, এবং সরকারের যথাযথ অনুমতি না পেলে সেই ঔষুধ চিকিৎকরা লিখতে পারেনা। ঔষুধটির মধ্যে কি কি উপাদান থাকবে, কোন উপাদানটি কোন কাজ করবে, কি কি সাইড ইফেক্ট আছে, নির্দিষ্ট ওষুটির পাশাপাশি আর কোনো ঔষুধ খাওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি তথ্য সরবরাহ করলে চিকিৎকরা ঔষুধটি লিখতে পারেন। সেদিক থেকে উপযুক্ত ঔষুধ না থাকাতে মানসিক বিশেষজ্ঞরা শুধুমাত্র সেক্সথেরাপিই দিতেন।
‘সেক্সথেরাপীর’ হলো যৌন সমস্যার সাইকোথেরাপী নির্ভর বিশেষ এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি। যার ব্যাবহার বা প্রয়োগ এখনো আছে।
বর্তমানে ভায়াগ্রা বা ভায়াগ্রার মতো অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। শুধু মানসিক বিশেষজ্ঞরাই নয় প্রায় সববিশেষজ্ঞরাই এই ঔষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারেন। এমনকি যারা জেনারেল প্রাক্টিশনার, তারাও লিখতে পারেন। তারপরও সমস্যা থেকে গেলে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে পারেন।
এই চিকিৎসায় যদি কোনো কারনে যথাযথ ফল না পাওয়া যায়, তবে পুরুষাঙ্গের ভিতরে প্রোস্থেসিস (একধরনের কৃত্রিম অংগ) বসানোর জন্য ইউরোলজিস্টের কাছে পাঠাবেন।
একটি ইরেক্টাইল ডিসফাংশনে ভুগতে থাকা রোগীর উদাহরন টেনে রেফারেল সিসটেমকে সহজভাবে তুলে ধরার চেস্টা করেছি।
পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সেক্সুয়াল ডিসফাংশন সম্পর্কেও বলার আশা রাখি।
চলবে…
ডা. এসএম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌন জীবন, ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অন্যান্য পর্বগুলোর লিংক নিচে দেয়া হলো-
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ১
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ২
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ৩
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের দায় নেবে না।
খুব দরকারি পোষ্ট। ধন্যবাদ সুন্দর লেখাটির জন্য। আশা করি এরকম আরো সুন্দর লেখা শীঘ্রই দেখতে পাবো। 🙂