বন্ধুমহল কিংবা পরিচিতজনদের মধ্যে অনেককেই বলতে শুনি অমুকের ব্যক্তিত্ব অনেক আকর্ষণীয় আর অমুক ব্যক্তিত্বহীন। আর মানুষের এ ব্যক্তিত্বের ওপরই নাকি নির্ভর করে সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু! স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ব্যক্তিত্ব জিনিসটা আসলেই কী?
ব্যক্তিত্ব এমন একটি বিষয়, দু-চার কথায় যেটা বোঝানো প্রায় অসম্ভব। তারপরেও সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্যক্তির সব বৈশিষ্ট্যের সামগ্রিক রূপকে বোঝায়, যা তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তির দৈহিক গঠন, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মনোভাব, আবেগ, প্রকাশভঙ্গি এ সব কিছুর সমন্বয়ে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে, কারো ব্যক্তিত্ব নেই এটা কথাটা মোটেও ঠিক নয়।
ব্যক্তিত্বের গঠন:
ব্যক্তিত্ব কী? তার উপাদান কী? এসব বিষয় নিয়ে রয়েছে অনেক তত্ত্ব, আলোচনা আর সমালোচনা। ব্যক্তিত্বের গঠন নিয়ে যারা তত্ত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত সমালোচিত নাম সিগমুন্ড ফ্রয়েড (মে ৬, ১৮৬৫- সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৩৯)।
ফ্রয়েড ছিলেন একজন অস্ট্রীয় মনোচিকিৎসক এবং মনস্তাত্ত্বিক। তিনি ‘মনোসমীক্ষণ’ (Psychoanalysis) নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক। যেসব ব্যক্তি তাদের তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন ফ্রয়েড তাদের মধ্যে অন্যতম।
ফ্রয়েডের মতে, আদিসত্তা (Id), অহম (Ego) এবং অধিসত্তা (Superego) এই তিনটি উপাদানে মানব ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। চলুন এগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
আদিসত্তা বা ইদ (Id) :
ব্যক্তিত্বকে যদি একটি সিস্টেমের সঙ্গে তুলনা করি তবে সেই সিস্টেমের সবচেয়ে পুরাতন অংশ হলো ইদ। এটি মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে তৈরি হয়। এই অংশের কাজ হলো ব্যক্তির কামনা, বাসনা মেটানোর জন্য কাজ করা।
আদিসত্তা বা ইদ প্রবৃত্তিকে (Instincts) ধারণ করে এবং প্রবৃত্তি থেকে শক্তি পায়। প্রবৃত্তি হলো ব্যক্তিত্বের মৌলিক উপাদান যা আমাদের আচরণের গতি ও দিক নির্ধারণ করে।
এই প্রবৃত্তি এমন এক প্রকার শক্তি যা শারীরিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শারীরিক চাহিদা ও মনের ইচ্ছাগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
আমাদের শরীরে যখন কোনো প্রয়োজন অনুভব করি তখন আমরা সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাজ করি।
এই আদিসত্তা ভোগ ও সুখের নীতি (Pleasure Principle) অনুসরণ করে। আদিসত্তা সব সময় আনন্দ পেতে চায় এবং ব্যথা-বেদনা এড়িয়ে চলে। আমাদের শরীর ও মনের চাহিদাগুলো আদিসত্তা তাৎক্ষণিক পূরণ করতে চায় এবং এক্ষেত্রে কোনো ধরনের দেরি সে মানতে পারে না। এটা দ্রুত সন্তুষ্টি পেতে চায়।
আদিসত্তা নিজের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে সেদিকে পরিচালিত করে অন্যদের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে চায় না।
ধরুন, আপনি আপনার বাবার কাছে একটি আইফোন চাচ্ছেন, আপনার আদিসত্তা এজন্য আপনার মধ্যে তাড়না তৈরি করে। আপনার বাবা কিছুদিন অপেক্ষা করতে বললেও, আদিসত্তা এই অপেক্ষা সহ্য করতে পারে না।
আদিসত্তা হলো ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন অংশ। আদিসত্তা থেকেই জন্ম হয় এই ইগো ও সুপারইগোর এবং আদিসত্তা থেকেই তারা শক্তি লাভ করে।
মনের অবচেতন স্তরটি আদিসত্তা ধারণ করে। এটি কোনো প্রকার যুক্তি, বিচার বুদ্ধি বা নৈতিক জ্ঞানের ধার ধারে না। বাস্তবতা (Reality) সম্পর্কে তার কোনোই আগ্রহ নেই। আর তাই বলা যায় আদিসত্তা হলো ব্যক্তিত্বের স্বার্থপর, প্রাচীন, নৈতিক চেতনা বর্জিত ও জেদি অংশ।
আদিসত্তাকে নবজাতক শিশুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যে তার চাহিদা পূরণ না হলে কান্নাকাটি করে, হাত-পা ছোড়াছোড়ি করে। কিন্তু জানে না কিভাবে তার সেই চাহিদা অর্জিত হবে।
অহম বা ইগো (Ego):
ইগো জন্মের পরপরই বিকাশ হতে থাকে। ব্যক্তিত্বের এই অংশটি চেষ্টা করে আদিসত্তার চাহিদা ও বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য। আদিসত্তার সুখভোগের নীতির বিপরীতে ইগো বাস্তবধর্মী নীতি (Reality Principle) মেনে চলে।
ইগোর কাজ হলো ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের বা বাস্তবতার সমন্বয় সাধন করা। আর এজন্য ইগো প্রবৃত্তির (Instincts) শক্তিকে সীমিত করে বা বাধাগ্রস্ত করে।
ইগো হলো ব্যক্তিত্বের কার্যনির্বাহী সত্তা (Executive), এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, বিভিন্ন কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান করে, যেটা আদিসত্তা পারে না। একে ব্যক্তিত্বের যৌক্তিক অংশ বলা যেতে পারে। তবে এর কাজ আদিসত্তার তাড়নাকে ঠেকানো বা প্রতিহত করা নয় বরং আদিসত্তার তীব্র আকাঙ্ক্ষাগুলোকে কীভাবে বাস্তবসম্মত উপায়ে, উপযুক্ত সময়ে নিবারণ করা যায় সেই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা। আদিসত্তাকে দেরি করানো, আকাঙ্ক্ষার গতিপথ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া।
ইগো যেহেতু বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন, তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় কখন, কিভাবে আদিসত্তার আকাঙ্ক্ষাকে সবচেয়ে ভালো ভাবে পূরণ করা যায়। এজন্য ইগো আদিসত্তার আকাঙ্ক্ষা নিবারণের জন্য সঠিক ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সময়, স্থান ও বস্তু নির্ধারণ করে। এভাবে ইগো আদিসত্তার আকাঙ্ক্ষাগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
ফ্রয়েড আদিসত্তা ও ইগোর সম্পর্ক বোঝানোর জন্য এদেরকে তুলনা করেছেন ঘোড়া (আদিসত্তা) ও সওয়ারির (ইগো) সঙ্গে। ঘোড়ার পাশবিক, অশিষ্ট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবশ্যই একজন সুদক্ষ সওয়ারি প্রয়োজন। যিনি ঘোড়াকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করবেন, অন্যথায় ঘোড়া তার সওয়ারিকে ফেলে তীরের বেগে দৌঁড়াবে কিংবা আরোহীকে মাটিতে ফেলে দেবে।
ইগো সর্বদা আদিসত্তা ও বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। তবে ইগো কখনোই আদিসত্তা থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না, কারণ ইগোর সৃষ্টি আদি থেকেই। ইগো কাজ করার শক্তিও পায় আদিসত্তা থেকে।
ধরুণ, আপনি একটা চাকরি করছেন, যেটা আপনার মোটেই পছন্দ নয়। কিন্তু, আপনি যদি এই চাকরিটা না করেন তাহলে আপনার পরিবার চরম আর্থিক অভাব-অনাটনে পড়ে যাবে। এক্ষেত্রে, আপনার বিকল্প কোনো উপায়ও নেই। তখন আপনার ইগো আপনাকে কাজটি চালিয়ে যেতে চাপ দেবে।
ফ্রয়েড বলেছেন, আমাদের আদিসত্তার কামনা-বাসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা ও সেটাকে দেরি করানোর অনুশীলন করতে হবে, যেটা ইগোর কাজ। যদি আমরা আমাদের আদিসত্তার কামনা বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি তবে ইদ আমাদের ইগোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা শুরু করবে। তখন আমাদের পক্ষে আর যৌক্তিকভাবে চিন্তা করা সম্ভব হবে না। তাই ব্যক্তিকে অবশ্যই ইদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া থেকে বাঁচতে হবে।
ফ্রয়েডের মতে, ইগো যখন ইদের তীব্র কামনা ও সুপার ইগোর কঠোর নিয়ম কানুনের মুখে তার সমন্বয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় ঘটে।
অধিসত্তা বা সুপারইগো (Superego) :
ব্যক্তিত্ব কাঠামোর তৃতীয় ও সর্বশেষ সত্তা বা উপাদান হলো অধিসত্তা বা সুপারইগো। সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় ব্যক্তির বিবেক। ব্যক্তিত্বের এই অংশটি বাস্তবতার তুলনায় ন্যায়-নীতির ওপর বেশি জোর দেয়। সামাজিক ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে এটি ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। এর প্রধান কাজ হলো আদিসত্তার কাম ও আক্রমাত্মক প্রেষণাকে অবদমন করা, ইগোকে বাস্তবধর্মী লক্ষ্যবস্তুর পরিবর্তে আদর্শধর্মী লক্ষ্যে প্রভাবিত করা এবং আরাম-আয়েশ অপেক্ষা নৈতিক কাজে ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা। এই বিশ্বাসগুলো ব্যক্তি সাধারণত শিশুকালে অর্জন করে।
আদিসত্তা তার কামনা-বাসনা পূরণ করতে চায় আর সুপারইগো সেখানে সম্পূর্ণভাবে বাধা দেয় আর বাস্তবতা তখন ভিন্ন কথা বলে। যখন ব্যক্তির ইগো এই ত্রিমুখী চাপ (আদিসত্তা, বাস্তবতা, বিবেক) সহ্য করতে না পেরে খেই হারিয়ে ফেলে, তখনই ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ, দুঃচিন্তা, আশঙ্কা (Anxiety) তৈরি হয়।